Friday, September 14, 2018

স্নিগ্ধা

স্নিগ্ধা



আসক্তি শব্দটা শুনতে যতটা খারাপ লাগুক না কেন, এর আলাদা এক মাধুর্য রয়েছে।
আমি মাদকদ্রব্যের মতো নিকৃষ্ট জিনিসের প্রতি আসক্তির কথা বলছি না। আমার আসক্তি শুধু তার ঠোঁটের এক মিষ্টি হাসি। তার চোখ যখন আমার চোখে তাকায়, সাথে সাথে মনটা আমার হারিয়ে যায়। তার চুল নিয়ে হাতের আঙ্গুলগুলোর মাঝে সারাদিন খেলার অনুভূতি তো অতুলনীয় এক অনুভূতি।

প্রত্যেক সকালে কাজে যাওয়ার পূর্বে আমাকে বলে, "আজ দেড়ি করবেন না কিন্তু। আপনার অপেক্ষায় কাটানো প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমাকে কষ্ট দেয়।" তখন আমি বলি, "তোমার কষ্ট যাতে না হয়, তাই বলেই তো কাজে যেতে হয়। কারণ তুমি কষ্ট পেলে আমি আরো বেশি কষ্ট পাই।" এটা বলে তাকে কাছে নিয়ে তার কপালে একটা চুমু দেই। তখন সে বলে, "ঠিক আছে। এবার যেতে পারেন। আজকের দিনটাও কাটবে শুধু আপনার অপেক্ষায়।" সেই মুহূর্তে তাকে একটা কবিতা বললাম, "অপেক্ষায় থাকি সারাদিন তোমার স্মৃতিতে, জানো না কতটা সুখ রয়েছে এই কষ্টকর অনুভূতিতে।" সারাদিন কাজের মাঝে ৬-৭ বার তার সঙ্গে ফোনে কথা বলি। তার গলার কন্ঠ যতবার শুনি, ততবারই ঠোঁটে এক হাসি ফুটে উঠে। দিনের একটা মিনিট এমন নেই, যখন আমি তার কথা মনে করি না। কাজ শেষ করে বাসার দিকে দৌড় দেই। তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছানোর চেষ্টা করি শুধুমাত্র তার মুখে একটা হাসি দেখতে। সেই হাসিটা যেন আমার জন্য বেঁচে থাকার অন্যতম একটি কারণ হয়ে গিয়েছে। রাতে হাত-মুখ ধুয়ে যখন ফ্রেশ হয়ে যখন মুখ মুছতে নেই, তখন সে নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে অনেক যত্ন সহকারে আমার চেহারা মুছে দেয়। মুছে দেয়ার সময় আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি আর সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, "এই, কি হলো আপনার? কি ভাবছেন? হূমম!" আমি তার উত্তরে বলি, "চিন্তা করছি কি করে তোমার মতো কাউকে পেলাম! কি আসলেই কেউ কাউকে এত ভালবাসতে পারে?" তখন সে বলে, "আপনি প্রতিদিন আমাকে এটাই জিজ্ঞাসা করেন কেন? আপনে কি আমাকে কোনো অংশে কম ভালবাসেন?" আর এই এক কথায় সে প্রত্যেকবার আমাকে চুপ করিয়ে দেয়।

রাতে যখন একসঙ্গে খেতে বসি, তখন সে আমাকে নিজের হাতে খাওয়ায়। কিন্তু আমি তাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করলে আমাকে বলে, "আপনি সকাল থেকে এত কাজ করলেন, নিশ্চয়ই এখন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন। আপনার কষ্ট করার কোনো দরকার নেই। আমি ভাল করেই জানি আপনি আমাকে কতটা ভালবাসেন।" আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে তার সঙ্গে কিছুক্ষণ তর্ক করি, কিন্তু তার সাথে পারা যায় না। পারবই বা কি করে? আমি তাকে যতটা ভালবাসি, তার চেয়ে বেশি সে আমাকে ভালবাসে। সে আসলেই আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অংশ। তার ত্যাগের পরিমাণের তুলনায় আমার ত্যাগগুলো কিছুই না। তার এই অমূল্য ভালবাসার তুলনায় আমার ভালবাসা মূল্যহীন হয়ে দাঁড়ায়। এই মূল্য পরিশোধ করার জন্য আমার সারাটা জীবনও খুব কম।

আমার এবং তার মধ্যে একটি অনেক বড় মিল হলো আল্লাহ্ তা'আলার প্রতি এক অসীম ভালবাসা। তাকে ক্লান্ত ভেবে একদিন ফজরের সময় তাকে উঠইনি। সেদিন সারাটা দিন আমার উপর রাগ করেছিল। আমি তাকে বোঝানোর জন্য বললাম, "প্লিজ রাগ কইরো না। আমি ভেবেছিলাম তুমি সারাদিন বাসার কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ, তাই তোমার ঘুম নষ্ট করতে চাইনি।" কিন্তু একথা শুনে সে আমাকে এমন একটা কথা বলল, যা আমার কান পবিত্র করে ফেলল। সে আমাকে বলল, "আপনি এটা কিভাবে ভেবে নিলেন, আমি আল্লাহ্-র ইবাদাত করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ব? ইবাদাত করার প্রতি অবহেলা তো আল্লাহ্-র প্রতি নাফরমানি। যেই আল্লাহ্ আমার জীবনে আপনার মতো স্বামী দিয়েছে, সেই আল্লাহ্-র প্রতি নাফরমানি আমে মোটেও সহ্য করতে পারব না।" সেদিন আমি বুঝতে পেলাম সে আল্লাহ্-র তরফ থেকে আমার জন্য কত মূল্যবান একটা উপহার।ছুটির দিন দেড়ি করে উঠে বিছানা নিজের হাতে অগোছালো করে দিতাম। এমনটা করতাম শুধুমাত্র তাকে একটু রাগ দেয়াতে। রাগ করলে অন্যদের মতো বকাঝকা করে না, আমার দিকে চোখ বাকা করে তাকিয়ে একটা হাসি দিত। তার এই রূপটা দেখার জন্যও তাকে এতটুকু কষ্ট দিতাম এবং তারপর তার হাত ধরে, সরি বলে, কান ধরে ফেলতাম। সে আমার উপর রাগ করার অভিনয় করত। বলত, "না! এত সহজে ক্ষমা করব না।" আমিও তার সঙ্গে তাল দিয়ে অভিনয় করে জিজ্ঞাসা করতাম, "ক্ষমা পেতে হলে আমাকে কি করতে লাগবে? তুমি যা বলবা, তাই করব।" তখন একটু হেসে বলত, "এই কথা? তাহলে আজ রাতে আমাকে আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে চলবেন। নিরব রাস্তার মাঝে শুধু আমি আর আপনি।" আমি বলতাম, "ঠিক আছে! তবে এক শর্ত রয়েছে। তুমি এই গোলাপি শাড়িটা পড়বা।" তখন সে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, "আচ্ছা, ঠিক আছে।"তার সঙ্গে ছুটির সারাটা দিন কাটিয়ে দিতাম। দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটতো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থেকে। এক আলাদাই শান্তি আছে তার পাশে বসে থেকে। শুধু আমি আর স্নিগ্ধা, বাকি জগত্টার কোনো চিন্তা নেই। রাতে তাকে নিয়ে বের হতাম ঠিক ১১টার দিকে। বাসা থেকে বের হওয়ার পূর্বে তার হিজাবটা আমি নিজের হেতে বেধে দেই। বেধে দেয়ার পর সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, "বলেন তো, আমাকে কেমন লাগছে?" আমি মুখে একটি হাসি নিয়ে তার কাছে গেয়ি বলি, "এই! তোমার কি মনে হয়? পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে কখনও খারাপ লাগতে পারে?" তখন সে উত্তরে বলে, "না! কিন্তু সেটা আপনার মুখ থেকে শোনার জন্যই তো প্রতিবার জিজ্ঞাসা করি। কারণ আমি ভাল করে জানি, আপনি আমাকে কখনও মিথ্যা বলতে পারেন না।"