*সৌন্দর্য*
সৌন্দর্য কি?
উঃ সংজ্ঞায়িত করতে গেলে বলা যেতে পারে;
সৌন্দর্য হলো কারো গুণাবলিসমূহ; যেমন আকার আকৃতি, বর্ণ, অথবা গঠন, যা নান্দনিক ইন্দ্রিয়কে, বিশেষ করে চক্ষুকে সন্তুষ্ট করে থাকে, সেসবের সংমিশ্রণকে বলা হয় সৌন্দর্য।
উপরোক্ত সংজ্ঞা অনুসারে আমরা একটা জিনিস লক্ষ করতে পারি। অন্যান্য ইন্দ্রিয়র তুলনায় চক্ষুকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, চক্ষুই হলো সৌন্দর্যের মাধুর্য উপভোগ করার প্রধান উৎস। এর তুলনায় অন্যান্য ইন্দ্রিয় ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেগুলো পুরোপুরি অকার্যকর না হলেও সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে।
** এখন আমরা কিছু তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে সৌন্দর্যকে যাচাই করে দেখি। এর মাধ্যমে সৌন্দর্যের সম্বন্ধে নানান ধরনের মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত জানা যেতে পারে। নিম্নলিখিত আলোচনায় আমরা তাদের দৃষ্টিকোণ নিয়ে আলোচনা করবো যারা উপরোক্ত সংজ্ঞায় উল্লিখিত ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে এক বা একাধিক ইন্দ্রিয় হারিয়ে ফেলেছে বা তা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেছে। তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য অনুভব করার ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম এবং সম্ভাব্য কিছু নির্ণায়ক নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করবো। তার সঙ্গে যুক্ত নানান প্রশ্নেরও যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।
*)* উপরোক্ত সংজ্ঞা কি সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
উঃ কখনওই নয়।
এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের জন্য প্রযোজ্য। তাও সেই সকল মানুষ, যাদের চক্ষু রয়েছে।
![]() |
Sight |
*)* উপরোক্ত সংজ্ঞা কি অন্ধদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
উঃ কখনওই নয়।
উপরোক্ত সংজ্ঞায় সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত রয়েছে চক্ষুই হলো সৌন্দর্য অনুভব করার প্রধান ইন্দ্রিয়। এর মাধ্যমে এটা বলা যেতে পারে যে চক্ষুবিহীন মানুষ কখনওই সৌন্দর্য অনুভব করতে পারবে না। অথবা অন্তত পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবে না।
কিন্তু এর মানে এই না, যে তারা কোনোভাবেই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে না। এমনও হতে পারে, একজন অন্ধলোক সৌন্দর্যকে আরও ভালভাবে মর্যাদা দিতে পারবে। হতে পারে চক্ষু থাকা সত্ত্বেও কেউ পুরোপুরি মানসিক সন্তুষ্টি পাচ্ছে না। হতে পারে চক্ষু না থাকার কারণে কারও কণ্ঠস্বর শুনেই তার মধ্যে আরও বেশি মাধুর্য উপভোগ করতে পারে। হতে পারে শুধু শুনেই সন্তুষ্ট থাকা লোকটা সেই লোকের চেয়েও অধিক সুখে রয়েছে যে চক্ষু থাকার কারণে কারও শুনে ভাল লাগলেও, দেখে ভাল লাগছে না বলে অসন্তুষ্ট।
*)* এমন লোকজনকে কখনও সুখ এবং সন্তুষ্টি আশা করা উচিত না। কারণ সকল ইন্দ্রিয় ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও এরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে বাছাইয়ের চেষ্টা করে। প্রকৃত তো সর্বদাই সুন্দর। কিন্তু মানুষ সবখানেই আরও বেশি কিছু চায়। সবকিছুই তার কাছে একটা প্রতিযোগিতা। তাই এমন কিছু মানসিকতা থাকার কারণে অনেকের কাছে প্রকৃত সৌন্দর্যের সংজ্ঞা অনেকটা অস্পষ্ট।
কিন্তু একজন লোকের কাছে যদি চক্ষু এবং শ্রবণশক্তি উভয়ই না থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তির কাছে কি সৌন্দর্য উপভোগ করার কোনো উপায় নেই?
উঃ অবশ্যই রয়েছে।
সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য প্রধান ইন্দ্রিয় হিসেবে চক্ষুকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হলেও, তা একান্ত ইন্দ্রিয় নয় যার মাধ্যমে সৌন্দর্য অনুভব করা সম্ভব। হতে পারে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য শব্দের ভিন্ন অর্থ রয়েছে। কিন্তু সেই অনুভূতিও সৌন্দর্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আমরা সাধারণ অর্থে সেই সকল অনুভূতিকে অন্য কোনো নামে জেনে থাকি। কিন্তু নাম ভিন্ন হলেও কাজ একই। সেই কাজটা হলো মনকে সেই একই সন্তুষ্টির অনুভূতি দেওয়া।
![]() |
Sound |
অনেকে সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য নাকের সাহায্যও নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ ফুলের সুগন্ধির কথা বলা যেতে পারে। অনেকের কাছে ফুল দেখতে যতো সুন্দর, তার ঘ্রাণ শুঁকে ততটা উপভোগ করতে পারে না। কারণ সেই ব্যক্তির অন্যান্য ইন্দ্রিয় তাকে সেই সুগন্ধী পুরোপুরি উপভোগ করা হতে বঞ্চিত করতে পারে।
কিন্তু সেই ফুলের সুগন্ধি উপভোগ করার জন্য যদি তার কাছে নাকই প্রধান ইন্দ্রিয় হিসেবে থাকত, তাহলে তার অন্যান্য ইন্দ্রিয়, যেমন তার চক্ষু তার ধ্যান এড়ানোর কাজটা করতে পারতো না। এমতাবস্থায় সে মূলত তার নাকের উপর নির্ভর করতো এবং শুধু ফুলের ঘ্রাণ শুঁকার উপরেই সমস্ত মনোযোগ দিতে পারতো। এই লোকের কাছে সৌন্দর্যের অর্থ তার থেকে প্রথক যে ফুলকে দেখেই তার সৌন্দর্য উপভোগ করার চেষ্টা করছে। হতে পারে তার কাছে ফুলটা দেখতে সুন্দর মনে হচ্ছে না বলে সে ফুলের ঘ্রাণ শুঁকে যাচাই করতেও অনিচ্ছুক। হতে পারে সেই ফুলের সুগন্ধি যদি তার চোখে পট্টি পড়িয়ে নেওয়ানো হতো, তাহলে সেই ফুলকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুল হিসেবে ঘোষণা করতে সেই ব্যক্তি মোটেও দেরি করতো না। কিন্তু শুধুমাত্র তার চোখের উপর নির্ভর করার ফলে সেই ফুলের সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করা থেকে বিরত হয়ে গেলো। এক্ষেত্রে সৌন্দর্য যে উপাধি পেয়েছে, সেটা হচ্ছে সুগন্ধি। এই প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করার প্রধান উৎস চক্ষু নয় বরং নাক।
![]() |
Smell |
*)* কি বাকি ইন্দ্রিয়দের ক্ষেত্রে প্রথম তিনটি ইন্দ্রিয়র যুক্তিসমূহ যথাযথ গ্রহণযোগ্য হবে?
উঃ কিছু কিছু ক্ষেত্রে হ্যাঁ, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে না।
প্রশ্নটার সঠিক উত্তর জানার জন্য আরও কিছু তুলনামূলক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
** প্রথমত; আমাদের ভাল করে সনাক্ত করে নিতে হবে, বাকি ইন্দ্রিয়গুলোর কাজ কি কি।
** দ্বিতীয়ত; আমাদের ভাল করে সনাক্ত করে নিতে হবে, বাকি ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে সৌন্দর্য অনুভব করার ক্ষেত্রে কোনটার অবদান কোনটার তুলনায় বেশি।
** তৃতীয়ত; আমাদের ভাল করে সনাক্ত করে নিতে হবে, বাকি ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে কোনটার অবদান একজন মানুষের জীবনে কতটা এবং কেন।
আমরা জানি, উপরে আলোচিত প্রথম তিনটি ইন্দ্রিয় হচ্ছে;
] দৃষ্টিশক্তি
] শ্রবণশক্তি
] গন্ধশুঁকে বোঝার শক্তি
এই তিনটি ইন্দ্রিয় ব্যতীত মূল ইন্দ্রিয় রয়েছে আরও দুটো। কিন্তু সমগ্র বিশ্বজুড়ে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হিসেবে গণ্য করা হয় মনের লুকিয়ে থাকা বোধ শক্তি। এই ইন্দ্রিয়টি পৃথিবীর সকল স্বাভাবিক মস্তিষ্কজনিত মানুষের কাছে রয়েছে। একে বিবেক, আন্দাজ এবং উপস্থিত বুদ্ধির সংমিশ্রণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এই ইন্দ্রিয়টি কখন, কার জন্য এবং কীভাবে কাজে আসে, তা নিয়ে কোনো পুরোপুরি নিখুঁত সংজ্ঞা নেই। কারণ এই ইন্দ্রিয় কোন একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য বিখ্যাত নয়। এর কাজ হলো; এমন কিছু বিশেষ মুহূর্তে কাজে আসা, যার জন্য বাকি পাঁচটি ইন্দ্রিয় একত্রিত করেও কোনো সমাধান পাওয়া যায় না। এমন একটি ইন্দ্রিয় যা বাকি পাঁচটি ইন্দ্রিয়র সহায়ক হিসেবে কাজ করে, আবার সে সকল ইন্দ্রিয় অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায়, শেষ একটা সমাধান বের করতে একান্ত এবং অতুলনীয় ভূমিকা পালন করে।
যেহেতু এই ইন্দ্রিয়র সৌন্দর্য অনুভব করার ক্ষমতা আমরা কোনোভাবেই যাচাই করতে পারি না, সেহেতু এর অনুভূতি কতটা নিখুঁত তা জানারও কোনো উপায় আমাদের কাছে নেই। কারো মনের মধ্যে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, কেউই জানে না। সেই রহস্যের সঙ্গে লুকিয়ে থাকা চাওয়া-পাওয়া কেউও বলতে পারে না। একই পৃথিবীকে, একই মানের চক্ষুর মাধ্যমে, একই দৃশ্য দেখা দেয়। কোনো বর্ণে অমিল নেই। কোনো আকারে অমিল নেই। এই চক্ষু দিয়েই সকলের কাছে দৃশ্য সেই একই। তবুও সকলের মন এক না হবার কারণে কেউ কালোকে ঘৃণা করে, কেউ কালোর প্রেমে পড়ে যায়। কেউ সাদাকে বিরক্তিকর ভাবে, কেউ সাদা দেখেই মুগ্ধ হয়ে পড়ে। কেউ লাল রঙে দেখে ভালবাসা, কেউ দেখে তার হাতে রক্ত মাখা। কেউ নিল দেখে আকাশ ছুঁইতে চায়, কেউ নিল দেখে মনের মধ্যে বিষ মেশায়। কেউ সবুজ দেখে চিরসবুজ থাকার আশ্বাস পায়, কেউ সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে কাঁদে।
সকলে একই পৃথিবী, একই আলোয় দেখি। কিন্তু সেই আলোর রশ্মি শেষ হয় আমদের আবেগে। সেই সীমানা আমরা কখনও পাড় করতে পারবো না। যতই চেষ্টা করি না কেন। যতই আত্মত্যাগ শিকার করি না কেন। আমরা সর্বদাই নিজের আবেগের দাশ হিসেবে নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন করে দিব। কারণ এই ইন্দ্রিয় কখনও অসহায় ছিল না। এর অভাবে আমরা নিজেই অসহায় হয়ে পড়ব। কারণ যখন আর কোনো ইন্দ্রিয় আর বিশ্বাসযোগ্য থাকে না, তখন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই শেষ এবং শ্রেষ্ঠ বলে নিজেকে প্রমাণিত করে।
![]() |
Sixth Sense |
প্রথমত; আমরা বলতে পারি, স্পর্শের মাধ্যমে আমরা যা অনুভব করি, তা আমাদের ত্বকের সঙ্গে মূলত সম্পৃক্ত। আমাদের ত্বকের কাছে যা ভাল লাগে, তার প্রতি মস্তিষ্কের মধ্যে একটি প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টি হয়। এই প্রাথমিক ধারণা পরবর্তিকালে যেকোনো মূহুর্তে পরিবর্তন হবার ঝুঁকিতে থাকে। কেননা স্পর্শ হলো ত্বকের মতামতের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। আর ত্বকের মতামত প্রায় সময়ই পরিবর্তন হয়। এর কিছু বিশেষ কারণ থেকে থাকে। এই কারণগুলির মধ্যে একটি প্রধান কারণ হচ্ছে আবহাওয়ার পরিবর্তন। কারণ আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু কিছু বস্তুর প্রতি ত্বকের প্রতিক্রিয়া আলাদা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে একটি সহজ উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি; বরফ গ্রীষ্মকালে স্পর্শ করা সকলের কাছে অতি প্রিয় এবং আর্শীবাদতুল্য, আবার এই বরফই শীতকালে স্পর্শ করা হয়ে ওঠে অভিশাপতুল্য।
No comments:
Post a Comment