Thursday, August 6, 2020

Thesis Report: Governing Systems During Coronavirus

Thesis Report: Governing Systems During Coronavirus

Report by Muhammad Rafi

Overview

Muhammad Rafi published the thesis report titled 'Governing Systems During Coronavirus' on August 7, 2020. This report highlights the main points of progress that were made up to 1 August 2020 under the governance of each country's government: scaling up international coordination and support; scaling up each country's preparedness and response by the pillar; providing necessary resources during the crisis; funding for the people; taking necessary measures in prevention, and accelerating research and innovation. The report also discusses some of the key challenges faced by the governments so far and provides an update on the government response as part of an unprecedented approach to the pandemic.
Kalasophy_KALA


Copyright 2020, Muhammad Rafi
This report is created by Muhammad Rafi and published on Kalasophy by the author KALA.
This report is not to be recreated for any purposes without the direct written consent of the author.

Monday, March 2, 2020

সৌন্দর্য

*সৌন্দর্য*


সৌন্দর্য কি?
উঃ সংজ্ঞায়িত করতে গেলে বলা যেতে পারে;
সৌন্দর্য হলো কারো গুণাবলিসমূহ; যেমন আকার আকৃতি, বর্ণ, অথবা গঠন, যা নান্দনিক ইন্দ্রিয়কে, বিশেষ করে চক্ষুকে সন্তুষ্ট করে থাকে, সেসবের সংমিশ্রণকে বলা হয় সৌন্দর্য।

উপরোক্ত সংজ্ঞা অনুসারে আমরা একটা জিনিস লক্ষ করতে পারি। অন্যান্য ইন্দ্রিয়র তুলনায় চক্ষুকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে, চক্ষুই হলো সৌন্দর্যের মাধুর্য উপভোগ করার প্রধান উৎস। এর তুলনায় অন্যান্য ইন্দ্রিয় ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেগুলো পুরোপুরি অকার্যকর না হলেও সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকে।
** এখন আমরা কিছু তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে সৌন্দর্যকে যাচাই করে দেখি। এর মাধ্যমে সৌন্দর্যের সম্বন্ধে নানান ধরনের মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মতামত জানা যেতে পারে। নিম্নলিখিত আলোচনায় আমরা তাদের দৃষ্টিকোণ নিয়ে আলোচনা করবো যারা উপরোক্ত সংজ্ঞায় উল্লিখিত ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে এক বা একাধিক ইন্দ্রিয় হারিয়ে ফেলেছে বা তা ছাড়াই জন্মগ্রহণ করেছে। তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য অনুভব করার ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম এবং সম্ভাব্য কিছু নির্ণায়ক নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করবো। তার সঙ্গে যুক্ত নানান প্রশ্নেরও যথাযথ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।

*)* উপরোক্ত সংজ্ঞা কি সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
উঃ কখনওই নয়।
এটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের জন্য প্রযোজ্য। তাও সেই সকল মানুষ, যাদের চক্ষু রয়েছে।

beauty_eye
Sight


*)* উপরোক্ত সংজ্ঞা কি অন্ধদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
উঃ কখনওই নয়।
উপরোক্ত সংজ্ঞায় সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত রয়েছে চক্ষুই হলো সৌন্দর্য অনুভব করার প্রধান ইন্দ্রিয়। এর মাধ্যমে এটা বলা যেতে পারে যে চক্ষুবিহীন মানুষ কখনওই সৌন্দর্য অনুভব করতে পারবে না। অথবা অন্তত পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবে না।
কিন্তু এর মানে এই না, যে তারা কোনোভাবেই সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে না। এমনও হতে পারে, একজন অন্ধলোক সৌন্দর্যকে আরও ভালভাবে মর্যাদা দিতে পারবে। হতে পারে চক্ষু থাকা সত্ত্বেও কেউ পুরোপুরি মানসিক সন্তুষ্টি পাচ্ছে না। হতে পারে চক্ষু না থাকার কারণে কারও কণ্ঠস্বর শুনেই তার মধ্যে আরও বেশি মাধুর্য উপভোগ করতে পারে। হতে পারে শুধু শুনেই সন্তুষ্ট থাকা লোকটা সেই লোকের চেয়েও অধিক সুখে রয়েছে যে চক্ষু থাকার কারণে কারও শুনে ভাল লাগলেও, দেখে ভাল লাগছে না বলে অসন্তুষ্ট।

*)* এমন লোকজনকে কখনও সুখ এবং সন্তুষ্টি আশা করা উচিত না। কারণ সকল ইন্দ্রিয় ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও এরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে বাছাইয়ের চেষ্টা করে। প্রকৃত তো সর্বদাই সুন্দর। কিন্তু মানুষ সবখানেই আরও বেশি কিছু চায়। সবকিছুই তার কাছে একটা প্রতিযোগিতা। তাই এমন কিছু মানসিকতা থাকার কারণে অনেকের কাছে প্রকৃত সৌন্দর্যের সংজ্ঞা অনেকটা অস্পষ্ট।
কিন্তু একজন লোকের কাছে যদি চক্ষু এবং শ্রবণশক্তি উভয়ই না থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তির কাছে কি সৌন্দর্য উপভোগ করার কোনো উপায় নেই?
উঃ অবশ্যই রয়েছে।
সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য প্রধান ইন্দ্রিয় হিসেবে চক্ষুকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হলেও, তা একান্ত ইন্দ্রিয় নয় যার মাধ্যমে সৌন্দর্য অনুভব করা সম্ভব। হতে পারে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে সৌন্দর্য শব্দের ভিন্ন অর্থ রয়েছে। কিন্তু সেই অনুভূতিও সৌন্দর্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আমরা সাধারণ অর্থে সেই সকল অনুভূতিকে অন্য কোনো নামে জেনে থাকি। কিন্তু নাম ভিন্ন হলেও কাজ একই। সেই কাজটা হলো মনকে সেই একই সন্তুষ্টির অনুভূতি দেওয়া।

beauty_ear
Sound


অনেকে সৌন্দর্য অনুভব করার জন্য নাকের সাহায্যও নিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে উদাহরণস্বরূপ ফুলের সুগন্ধির কথা বলা যেতে পারে। অনেকের কাছে ফুল দেখতে যতো সুন্দর, তার ঘ্রাণ শুঁকে ততটা উপভোগ করতে পারে না। কারণ সেই ব্যক্তির অন্যান্য ইন্দ্রিয় তাকে সেই সুগন্ধী পুরোপুরি উপভোগ করা হতে বঞ্চিত করতে পারে।
কিন্তু সেই ফুলের সুগন্ধি উপভোগ করার জন্য যদি তার কাছে নাকই প্রধান ইন্দ্রিয় হিসেবে থাকত, তাহলে তার অন্যান্য ইন্দ্রিয়, যেমন তার চক্ষু তার ধ্যান এড়ানোর কাজটা করতে পারতো না। এমতাবস্থায় সে মূলত তার নাকের উপর নির্ভর করতো এবং শুধু ফুলের ঘ্রাণ শুঁকার উপরেই সমস্ত মনোযোগ দিতে পারতো। এই লোকের কাছে সৌন্দর্যের অর্থ তার থেকে প্রথক যে ফুলকে দেখেই তার সৌন্দর্য উপভোগ করার চেষ্টা করছে। হতে পারে তার কাছে ফুলটা দেখতে সুন্দর মনে হচ্ছে না বলে সে ফুলের ঘ্রাণ শুঁকে যাচাই করতেও অনিচ্ছুক। হতে পারে সেই ফুলের সুগন্ধি যদি তার চোখে পট্টি পড়িয়ে নেওয়ানো হতো, তাহলে সেই ফুলকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুল হিসেবে ঘোষণা করতে সেই ব্যক্তি মোটেও দেরি করতো না। কিন্তু শুধুমাত্র তার চোখের উপর নির্ভর করার ফলে সেই ফুলের সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করা থেকে বিরত হয়ে গেলো। এক্ষেত্রে সৌন্দর্য যে উপাধি পেয়েছে, সেটা হচ্ছে সুগন্ধি। এই প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করার প্রধান উৎস চক্ষু নয় বরং নাক।

beauty_nose
Smell


*)* কি বাকি ইন্দ্রিয়দের ক্ষেত্রে প্রথম তিনটি ইন্দ্রিয়র যুক্তিসমূহ যথাযথ গ্রহণযোগ্য হবে?
উঃ কিছু কিছু ক্ষেত্রে হ্যাঁ, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে না।
প্রশ্নটার সঠিক উত্তর জানার জন্য আরও কিছু তুলনামূলক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
** প্রথমত; আমাদের ভাল করে সনাক্ত করে নিতে হবে, বাকি ইন্দ্রিয়গুলোর কাজ কি কি।
** দ্বিতীয়ত; আমাদের ভাল করে সনাক্ত করে নিতে হবে, বাকি ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে সৌন্দর্য অনুভব করার ক্ষেত্রে কোনটার অবদান কোনটার তুলনায় বেশি।
** তৃতীয়ত; আমাদের ভাল করে সনাক্ত করে নিতে হবে, বাকি ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে কোনটার অবদান একজন মানুষের জীবনে কতটা এবং কেন।

আমরা জানি, উপরে আলোচিত প্রথম তিনটি ইন্দ্রিয় হচ্ছে;
] দৃষ্টিশক্তি
] শ্রবণশক্তি
] গন্ধশুঁকে বোঝার শক্তি
এই তিনটি ইন্দ্রিয় ব্যতীত মূল ইন্দ্রিয় রয়েছে আরও দুটো। কিন্তু সমগ্র বিশ্বজুড়ে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় হিসেবে গণ্য করা হয় মনের লুকিয়ে থাকা বোধ শক্তি। এই ইন্দ্রিয়টি পৃথিবীর সকল স্বাভাবিক মস্তিষ্কজনিত মানুষের কাছে রয়েছে। একে বিবেক, আন্দাজ এবং উপস্থিত বুদ্ধির সংমিশ্রণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এই ইন্দ্রিয়টি কখন, কার জন্য এবং কীভাবে কাজে আসে, তা নিয়ে কোনো পুরোপুরি নিখুঁত সংজ্ঞা নেই। কারণ এই ইন্দ্রিয় কোন একটি নির্দিষ্ট কাজের জন্য বিখ্যাত নয়। এর কাজ হলো; এমন কিছু বিশেষ মুহূর্তে কাজে আসা, যার জন্য বাকি পাঁচটি ইন্দ্রিয় একত্রিত করেও কোনো সমাধান পাওয়া যায় না। এমন একটি ইন্দ্রিয় যা বাকি পাঁচটি ইন্দ্রিয়র সহায়ক হিসেবে কাজ করে, আবার সে সকল ইন্দ্রিয় অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায়, শেষ একটা সমাধান বের করতে একান্ত এবং অতুলনীয় ভূমিকা পালন করে।

যেহেতু এই ইন্দ্রিয়র সৌন্দর্য অনুভব করার ক্ষমতা আমরা কোনোভাবেই যাচাই করতে পারি না, সেহেতু এর অনুভূতি কতটা নিখুঁত তা জানারও কোনো উপায় আমাদের কাছে নেই। কারো মনের মধ্যে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে, কেউই জানে না। সেই রহস্যের সঙ্গে লুকিয়ে থাকা চাওয়া-পাওয়া কেউও বলতে পারে না। একই পৃথিবীকে, একই মানের চক্ষুর মাধ্যমে, একই দৃশ্য দেখা দেয়। কোনো বর্ণে অমিল নেই। কোনো আকারে অমিল নেই। এই চক্ষু দিয়েই সকলের কাছে দৃশ্য সেই একই। তবুও সকলের মন এক না হবার কারণে কেউ কালোকে ঘৃণা করে, কেউ কালোর প্রেমে পড়ে যায়। কেউ সাদাকে বিরক্তিকর ভাবে, কেউ সাদা দেখেই মুগ্ধ হয়ে পড়ে। কেউ লাল রঙে দেখে ভালবাসা, কেউ দেখে তার হাতে রক্ত মাখা। কেউ নিল দেখে আকাশ ছুঁইতে চায়, কেউ নিল দেখে মনের মধ্যে বিষ মেশায়। কেউ সবুজ দেখে চিরসবুজ থাকার আশ্বাস পায়, কেউ সবুজ ঘাসের ওপর শুয়ে শুয়ে কাঁদে।
সকলে একই পৃথিবী, একই আলোয় দেখি। কিন্তু সেই আলোর রশ্মি শেষ হয় আমদের আবেগে। সেই সীমানা আমরা কখনও পাড় করতে পারবো না। যতই চেষ্টা করি না কেন। যতই আত্মত্যাগ শিকার করি না কেন। আমরা সর্বদাই নিজের আবেগের দাশ হিসেবে নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন করে দিব। কারণ এই ইন্দ্রিয় কখনও অসহায় ছিল না। এর অভাবে আমরা নিজেই অসহায় হয়ে পড়ব। কারণ যখন আর কোনো ইন্দ্রিয় আর বিশ্বাসযোগ্য থাকে না, তখন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই শেষ এবং শ্রেষ্ঠ বলে নিজেকে প্রমাণিত করে।

beauty_sixth_sense
Sixth Sense

এখন আমরা এমন একটি ইন্দ্রিয় সম্পর্কে আলোচনা করবো, যা সকলের কাছে ভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। আমরা এবার আলোচনা করবো স্পর্শ নিয়ে। আমরা স্পর্শ বলতে এখানে মূলত কোনো বস্তুর সঙ্গে শারীরিক সংস্পর্শের দ্বারা উৎপাদিত অনুভূতিকে নিয়েই আলোচনা করবো এবং তা সৌন্দর্য অনুভব করার ক্ষেত্রে কতটুকু কার্যকর, তা নিয়েও বিশেষ কিছু দৃষ্টিকোণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।
প্রথমত; আমরা বলতে পারি, স্পর্শের মাধ্যমে আমরা যা অনুভব করি, তা আমাদের ত্বকের সঙ্গে মূলত সম্পৃক্ত। আমাদের ত্বকের কাছে যা ভাল লাগে, তার প্রতি মস্তিষ্কের মধ্যে একটি প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টি হয়। এই প্রাথমিক ধারণা পরবর্তিকালে যেকোনো মূহুর্তে পরিবর্তন হবার ঝুঁকিতে থাকে। কেননা স্পর্শ হলো ত্বকের মতামতের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। আর ত্বকের মতামত প্রায় সময়ই পরিবর্তন হয়। এর কিছু বিশেষ কারণ থেকে থাকে। এই কারণগুলির মধ্যে একটি প্রধান কারণ হচ্ছে আবহাওয়ার পরিবর্তন। কারণ আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে সাথে কিছু কিছু বস্তুর প্রতি ত্বকের প্রতিক্রিয়া আলাদা হয়ে থাকে। এদের মধ্যে একটি সহজ উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি; বরফ গ্রীষ্মকালে স্পর্শ করা সকলের কাছে অতি প্রিয় এবং আর্শীবাদতুল্য, আবার এই বরফই শীতকালে স্পর্শ করা হয়ে ওঠে অভিশাপতুল্য।

Monday, December 16, 2019

যাযাবর মন

খাগড়াছড়ি এলাকার কিছু বিশেষ পাহাড়-পর্বত দর্শনের জন্য গাড়িতে করে সকাল সকাল এসে পড়লাম। বাসায় থেকে থেকে এই সাদামাটা জীবন যাপন করে বিরক্তি অনুভব করছি। নিতী-নৈতিকতার পিঞ্জরে আর এক মুহূর্তও জীবনের প্রকৃত আনন্দ-উল্লাস উপভোগ করতে পারছি না। কি এই জীবন, যদি উপভোগ করতে না পারি? তাই আজ এই পাহাড়ের কোনায় দাঁড়িয়ে একটা বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার চিন্তা করছি। শহরের উত্তপ্ত গ্রীষ্মকালীন হাওয়ায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তাই এমন কোথাও আসতে হলো, যেখানে সিদ্ধান্তের এক বিশেষ স্বাধীনতা রয়েছে। এখানে রয়েছে মুক্তভাবে চিন্তার এক আলাদাই সুযোগ। এই সুযোগে আজ সিদ্ধান্ত নিলাম পরক্রিয়া করার।
শুধু একটা সিদ্ধান্ত করবার জন্য এতো দূরে আসা অনেকের কাছেই ভীষণ মাত্রার বোকামি মনে হতে পারে, তবে তাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষের কাছে সেই জিনিসের অভাব, যা আমার কাছে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত; আর সেটা হলো টাকা।
ধনী এবং ক্ষমতাসীন পরিবারে জন্ম নেওয়ার সবচাইতে বড় সুবিধা হলো অঢেল পরিমাণ টাকার মালিক হওয়া। এতো টাকার মালিক হওয়া অনেকের স্বপ্ন। আমার জন্ম এবং বংশপরিচয় আমাকে এই বিশেষ সুবিধা উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছে। তবে এ সকল সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতাও অবশ্যই রয়েছে। আমার অবস্থা মূলত সেই লোভী লোকটার মতো যে দিনরাত শুধু স্বর্ণের স্পর্শ পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করতো। যেই মুহূর্তে তাকে আশীর্বাদ দেওয়া হলো, তার খুশির মাত্রা আকাশ ছুঁয়ে দিল। তার আশীর্বাদ ছিল; সে যা স্পর্শ করবে, তা স্বর্ণে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। কিন্তু নিজের কন্যাকে আদর করতে গিয়ে যখন তাকেও স্বর্ণে রূপান্তরিত করে ফেললো, তখন সে বুঝতে পেল, সে যেটাকে আশীর্বাদ বলে খুশি হচ্ছিল, সেটা আসলে অভিশাপ ছিল। তাকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল তার লোভ দূরীকরণের জন্য, কিন্তু আমার ধনসম্পত্তি কি আদতে আমার জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ, তা আমার জানা নেই। ছোটবেলায় শোনা গল্প নিয়ে এতো বছর পর নিজেকে যাচাই করছি। আমি কি আদৌ একজন পরিপূর্ণ সুখী মানুষ? আমি কি আদৌ নিজেকে পুরোপুরি জীবিত একজন মানুষ হিসেবে দাবি করার যোগ্য?
মূলত এই প্রশ্নগুলির উত্তর অনুসন্ধান করার জন্যই এই স্থানে আসা। উত্তর হয়তোবা আজকে নাও পেতে পারি, কিন্তু যেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলছি, তা অবশ্যই বাস্তবায়নের চেষ্টা আজ রাত থেকেই শুরু করবো। কিন্তু তা এখানে করবো না; করবো শহরে ফিরে। কারণ দূরে কোথাও পরক্রিয়া করা একটা নিরাপদ সিদ্ধান্ত হলেও, এতে পরক্রিয়া করার প্রকৃত মজা উপস্থিত নেই। একই শহরে, আশেপাশের কোনো এলাকার, তাও আবার সুপরিচিত লোকদের মাঝে দেখা করা, ঘোরাফেরা করা এবং সবার সামনে নির্লজ্জভাবে মেলামেশার মধ্যেই রয়েছে পরক্রিয়ার আসল রস। আর এসব আরো অনেক বেশি আনন্দদায়ক মনে হয়, যখন মনে পড়ে আমার স্ত্রী নিজেই এই গোটা শহরের একজন অত্যন্ত বিখ্যাত নেত্রী এবং সাধারণ জনগণের কাছে অত্যন্ত কুখ্যাত একজন সন্ত্রাসী।
ধনী এবং ক্ষমতাসীন এক পরিবারের সদস্য হয়ে জন্ম নেওয়ার এই একটাই অসুবিধা। আমার বিয়ের সময় আমার মত ঠিকই নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রশ্নটা ছিল, "দেখ, এদের মধ্যে কোন নেত্রীকে পছন্দ হয়?"
উত্তর দেওয়ার পূর্বে আমি জিজ্ঞাস করেছিলাম, "এদের বাহিরে কাউকে বাছাই করা যাবে না?"
আমার প্রশ্নের উত্তর পাবার এই ছয়টা বছর গেল। এখনও সেই উত্তর মাথায় ঘুরে। আমার বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন, "এই প্রশ্নের উত্তর তুই নিজেও ভাল করে জানিস।"
হ্যাঁ! আমি সবই ভাল করে জানি। দুটো পরিবার এভাবে আত্মীয়তার মাধ্যমে একত্রিত হলে এতে উভয় পক্ষের বিশেষ স্বার্থ পূরণ হবে। আমার একার এখানে কিছুই বলার মতো নেই। শুধু তাদের দেখানো কটির মধ্যে একজনকে বেছে নেয়াই ছিল একমাত্র করণীয়। তাই এমন এক পাত্রী বাছাই করলাম, যে স্বভাবত বদমেজাজি এবং নিতান্ত লম্পট এক মহিলা।
আমার এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে বিশেষ কিছু কারণ ছিল। প্রধান কারণ ছিল তার যাযাবর স্বভাব এবং চরিত্রহীন আচরণ। তাকে দেখলেই যে কেউ বুঝতে পারতো, সে কত বড় মাপের নির্লজ্জ এক মহিলা। মুখে অধিকাংশ সময় গালিগালাজ শোনা যায়। পর পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা। রাতবিরেতে নাইট ক্লাবে প্রচুর পরিমাণে মদ খেয়ে পার্টি করা। সেসময় তার এ সকল নির্লজ্জতা আমাকে বিশেষভাবে আকর্ষিত করেছিল। কারণ আমি এমন ধরনেরই লম্পট অনুসন্ধান করছিলাম আমার মনের যত নোংরা কল্পনা আজে, তাদের সকলকে পূরণ করতে।
কিন্তু বিয়ের রাত জানতে পেলাম, ব্যাপারটা ঠিক তা না। মেয়েটা এগুলো শখ করে করতো না, করতো অন্য কারণে। এগুলির মধ্যে কিছু কিছু কাজ সে করতো শুধু মানুষদের দেখানোর জন্য। তার মনের আসল কথা সে আমার কাছে সেই রাত খুলে বললো। চরিত্রহীন হবার অভিনয় করার কারণ ছিল যাতে কেউ তাকে বিয়ের জন্য বাছাই না করে ফেলে। কারণ সে ভেবেছিল, এমন এক কলঙ্কিত মেয়েকে কে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে? সে কখনও ভাবতেও পারেনি, আমার মতো রুচিসম্মত লোকজনও এই পৃথিবীতে রয়েছে। সে এই অভিনয়টা করছিল তার তৎকালীন প্রেমিক; মানিকের জন্য।
তার পরিবার ছেলেটাকে মেনে নিতে পারছিল না। তাই এসব অভিনয় করে একসময় পালিয়ে বিয়ে করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা। কিন্তু তাদের আদৌ কোনো জ্ঞান ছিল না যে আমি তাদের এই প্রেম কাহিনীর খলনায়ক হয়ে প্রকট হয়ে পড়ব। সেই রাত আমাকে ওসব বলার সে প্রতিজ্ঞা করলো, সে আমার হয়েই বাকিটা জীবন কাটাবে। একথা শুনে অনেকের কাছেই ভাল লাগত, কিন্তু আমার কাছে খুবই খারাপ লাগল। বেচারি মনে করছিল, তার মতো চরিত্রহীন মেয়েকে বিয়ের করবার পেছনে আমার উদার মানসিকতার প্রকাশ পেয়েছে। আমি নাকি তার কাছে একজন ফেরেশতা। আমার এসব কথা শুনে বেশ বিরক্তিকর লাগছিল বলে সেই রাত আমি ঘর থেকে বের হয়ে প্রায় পঁচিশ থেকে ত্রিশটা সিগারেট খেলাম। কতো পরিকল্পনা করেছিলাম তাকে নিয়ে, আর সে বের হলো শুষ্ক এক ভদ্রমহিলা।
তার পরের সকাল সে আমাকে অরো জানালো, তার গর্ভে তার প্রাক্তন প্রেমিক; মানিকের সন্তান আছে। এ সংবাদ শোনার সাথে সাথে তাকে এক চড় মেরে, টেনে হিচড়ে, হসপিটালে নিয়ে, তার গর্ভপাত করিয়ে ফেললাম।
এ খবরটি তার প্রাক্তন প্রেমিক; মানিকের কানে পৌঁছানোর পরের সকাল তার লাশ, তার বাসার পাখায় ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেল। কিন্তু সংবাদদাতা এবং তাকে পাখায় ঝুলিয়ে হত্যাকারী আমিই ছিলাম। আমি নিজেই গিয়ে তাকে বার্তাটুকু প্রেরণ করলাম এবং তাকে ফাঁসি দিয়ে এসে পড়লাম।
ছেলেটা শহরে একা থাকতো। কেউ খুব ভাল করে তাকে জানতও না। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই আমি তার হত্যা করে তাকে আত্মহত্যার রূপ দিয়ে দিলাম। পুলিশ তদন্তের পরও কেউ কোনোভাবেই আমার উপর সন্দেহ করার চিন্তাও করেনি। কারণ ছেলেটা নিজের প্রেম কাহিনী দুনিয়ার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল। তাই কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না, ছেলেটার প্রাক্তন প্রেমিকার বর্তমান স্বামী এই কাজটি করতে পারে।
আমার স্ত্রী; মিমি এ খবর শুনে পুরোপুরি ভেঙে পড়ল এবং প্রায় দুই মাস বিধবার মতো মনমরা হয়ে পড়েছিল। প্রথমে প্রথমে কিছুটা মায়া লাগলেও, অনেক বেশি আনন্দ বোধ করছিলাম তার এই দশা দেখে। বিয়ে হবার এই ছয় বছরে কখনও আমার ছাড়া কোনো পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করেনি।
বাসার আনাচেকানাচে মোট ত্রিশটা গুপ্ত ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আমার ছাড়া তার জীবনে আর কেউই নেই। আর নেই যার সঙ্গে সে দিনরাত কাটাতে আগ্রহী। ব্যাপারটা আমার কাছে আরো বিরক্তিকর লাগছিল। তার এই সকল বিরক্তিকর কর্মকাণ্ডের জন্য আজ আমার এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া।

রাতে প্রায় তিনটার দিকে শহরের কুখ্যাত পতিতালয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সড়কের পাশেই লাইন ধরে মহিলারা দাঁড়িয়ে থাকে। এই সড়কটা এতটাই কুখ্যাত, যে কোনো ভদ্র ঘরের মানুষ এখানে এক মুহূর্তও টিকে থাকতে পারে না। এখনকার মূল দালাল আমার এক চাচাতো ভাইয়ের বিজনেস পার্টনার, তাই এতো কুখ্যাত হবার সত্ত্বেও এখনও এই নোংরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। প্রতিরাতের মতই আজও অসাধারণ অতিরিক্ত সাজগোজ করে একেকটা ময়দার বস্তার মতো দাঁড়িয়ে আছে। এতগুলো কুৎসিত ময়দার বস্তার মধ্যে একজনকে দেখে বেশ সাদাসিধে ও ভদ্র ঘরের মনে হচ্ছে। মেয়েটা লাইনের শেষ কোণায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমার গাড়ির আগের দুটো গাড়ির গ্রাহকদের না করে দিল। মেয়েটা দেখতে কোনো দিক দিয়েই পতিতা মনে হচ্ছিল না। তাই আমি আমার নতুন সিদ্ধান্তের জন্য তাকে বেছে নিলাম।
গাড়িটা তার কাছে নিয়ে, কাঁচ নামিয়ে, জিজ্ঞেস করলাম, "এই, রেট কতো?" আমার চোখে চোখ মেলাতে খুবই অস্বস্তিকর লাগছিল।
"এক ঘণ্টা পাঁচ হাজার টাকা।" সে বললো এক বিব্রত কন্ঠে।
তার গলার স্বর শুনেই বুঝতে পারলাম যে এটা তার প্রথমবার। এই ব্যবসায় সম্পূর্ণ নতুন। তার চেহারায় সেই স্নায়বিক দুর্বলাবস্থা দেখে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলাম। তার চাওয়া দাম বেশ উঁচু ছিল। পাঁচ হাজার টাকায় মাত্র এক ঘণ্টায় আমার পরিচিত কেউই রাজি হবে না। কিন্তু অঢেল পরিমাণ টাকা থাকার অর্থই হলো অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে তো ব্যয় করতেই হবে। তাই আর না ভেবে, হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে বললাম গাড়ির পেছনের সিটে বসে পড়তে। আমার ইশারা বুঝতে পারা সত্ত্বেও মেয়েটা জিজ্ঞাস করলো, "রেটটা ঠিক আছে কি না, আগে তা বলেন। এক ঘণ্টার পাঁচ হাজার দিতে রাজি?"
এতটুকু বলতেই তার ভয়ে হাত-পা কাঁপছিল। তার এই অসহায় অবস্থা দেখে আমি হালকা রেগে গেলাম। কিন্তু রাগ নিয়ন্ত্রণে রেখে, তার চেহারার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম, "হ্যাঁ! আমি সবকিছুতে রাজি। এখন দরজাটা খুলে ভিতরে বসে পড়ো।"
আমার উত্তর শোনার পর, আমার কথামতো সে গাড়ির পেছনের সিটে বসে পড়ল। গাড়ির ভেতরে বসে থাকা অবস্থায়ও সে অনেক বেশি আতঙ্কিত ছিল। তার চেহারায় এই আতঙ্ক দেখে আমার উত্তেজনা আরো বেড়ে গেল।
গাড়িতে করে তাকে মতিঝিলের নতুন এক আবাসিক হোটেল; পশ ডাইনেস্টি (Posh Dynasty) হোটেলে নিয়ে গেলাম। হোটেলটা নতুন বলতে পুরোপুরি নতুন না, কিন্তু এখানকার বাকি হোটেলগুলোর তুলনায় নতুন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
হোটেলটা তুলনামূলক নতুন হওয়ার ফলে এখানে অনেক কম মানুষ থাকে। অন্য অর্থে বলা যেতে পারে, এটা আমার পরক্রিয়া করার সিদ্ধান্তের জন্য একদম দারুণ একটা জায়গা। এখনকার স্টাফরাও আমাকে চেনে না, যা আশেপাশের অধিকাংশ হোটেলে চেনে।
রুমে ঢুকে সবচেয়ে প্রথমে আশেপাশে কোনো গুপ্ত ক্যামেরা লাগানো আছে কি না, তা খুঁজতে শুরু করলাম। ভাগ্যবশত কোথাও এমন কিছু খুঁজে পাইনি। আমার এসব কান্ড দেখে, মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। তার চেহারায় বিভ্রান্তির ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
আমি তার কাছে গিয়ে বসলাম। আমাদের মাঝে ভালই দূরত্ব বিদ্যমান ছিল। মেয়েটা কিছু বলার আগেই আমি বললাম, "এতটুকু দূরত্ব ঠিক আছে, নাকি আরো দূরে সরে বসব?"
মেয়েটি আশ্চর্য হয়ে তাকাল। তার তাকানোর ভঙ্গি দেখেই তার মনে জাগ্রত একশো একটা প্রশ্নের ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল। মেয়েটা বেশ ভদ্রভাবে বসে ছিল। আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে, নীরব হয়ে বসে ছিল। তা দেখে একটুর জন্য মনে হলো, একজন সাধারণ পতিতা নিয়ে আসাটাই আরো সুবিধার হতো। কিন্তু তাকে বাছাই করার যে কারণটা রয়েছে, তাও তো মাথায় রাখতে হবে। তাকে তো শুধু এক রাতের তৃপ্তি মেটানোর উদ্দেশ্যে নিয়ে আসিনি; এনেছি আমার সঙ্গে হওয়া প্রতারণার জবাব দিতে।
পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে তাকে জিজ্ঞাস করলাম, "এক ঘণ্টার জন্য পাঁচ হাজার হলে, সকাল পর্যন্ত কত টাকা নিবা?"
আমার প্রশ্ন শুনে বেশ অবাক হলো মেয়েটা। আমার দিকে চোখ করে তাকিয়ে, আবার নীচে তাকিয়ে বললো, "আমি সকাল পর্যন্ত থাকতে পারব না।"
একথা শুনে আমি নিশ্চিত হতে পারলাম, সে আসলেই এই পেশায় নতুন। তবে আমিও হার মানার মতো মানুষ না। ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছি, তা পেয়েছি। চাহিদার জিনিসটা চাহিবামাত্র পেয়ে যাবার অভ্যাস থাকলে, ছোটর চেয়ে ছোট জিনিসের দামও মুহূর্তের মধ্যে বেড়ে যায়।
আমি মুচকি হেসে বললাম, "এখনই তো সাড়ে তিনটার বেশি বাজছে। এক ঘণ্টা পর তো ভোর বেলায় বের হতে হবে। এতো ভোরে একটা যুবতী সুন্দরী মেয়ের রাস্তায় চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।"
মেয়েটি নিজের দু হাত দিয়ে নিজের পায়ের উপর বেশ ভাড় দিয়ে বললো, "আমি ওসব কিচ্ছু জানি না। আমি এক ঘণ্টা ছাড়া কোনোভাবেই পারব না।"
"আচ্ছা, দশ হাজারের জন্য দুই ঘণ্টা থাকতে পারবা?"
"না! আমার পক্ষে সম্ভব না।"
"ঠিক আছে! একটা কাজ করি। আমি নিজেই, গাড়িতে করে, তোমাকে ছেড়ে আসবো। গাড়ির মধ্যেও যতক্ষণ সম্ভব, আমাকে সময় দিও। তাহলে চলবে তো?"
মেয়েটা বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললো, "আমি বাসায় একাই যাবো। আমার আর আপনার সম্পর্ক এই কাজ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। তার চেয়ে বেশি না আমি আপনার কিছু, না আপনি আমার। আমার ব্যক্তিগত জীবনে আপনার কোনো স্থান নেই।"
"তোমার ব্যক্তিগত জীবনে আমার প্রবেশ করার কোনো উদ্দেশ্য নেই। তবে নিজের ব্যক্তিগত জীবনে তোমার অনুপ্রবেশ ঘটাতে আগ্রহ পোষণ করি।"
"মানে?"
"মানে বুঝতে কিছুটা কঠিন হলেও, অত্যন্ত সহজ সরল একটা বিষয়। আমি তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে চাই, আর কিছুই না।" একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আরো বললাম, "আমি একজন বিবাহিত, প্রতারিত এবং তৃপ্ত একজন পুরুষ। আমার জীবনে যতটা রস বিদ্যমান ছিল, তা সবই এক মুহূর্তের মধ্যে শূণ্য হয়ে গেল। সেই রস, সেই আনন্দ ফিরিয়ে আনতে আমি প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর আমি শুধু পরক্রিয়া শারীরিক ভাগে আগ্রহী না, আত্মিক ভাগেও প্রচুর আগ্রহ পোষণ করি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো বলতে পারো, আমার মূল উদ্দেশ্যই হলো ভালবাসার প্রতি নতুন অনুভূতি স্থাপন করা। কিন্তু এ কাজের সফলতার জন্য কিছু বিশেষ শর্তাবলি রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান শর্তাবলি হলো তোমার সম্মতি। তাই তোমার সঙ্গে সময় কাটিয়ে, তোমাকে ভাল করে জানতে চাই, বুঝতে চাই এবং আমাদের মাঝে বিদ্যমান দূরত্বটা মেটাতে চাই।"

Friday, October 18, 2019

কেদারায় ভ্রমণ (বাস্তবিক) - ৩.১

rocking-chair-4061640_1920
কেদারায় ভ্রমণ (বাস্তবিক)


আমি বাড়িতে ফেরার জন্য এবার বাসে না চড়ে, চড়লাম ট্রেনে। কারণ এত ভাঁড়ি ব্যাগ নিয়ে বাসে চড়লে এমন নিবিড় রাতে নিশ্চয়ই ছিনতাই হবার সুযোগ রয়েছে। যশোরের ট্রেনে উঠার সময় কিছু আশ্চর্যজনক ব্যাপার খেয়াল করলাম। ট্রেনের মধ্যে মানুষের সংখ্যা ছিল খুবই কম। মনে হচ্ছিল যেন বাকি সবাইকে ওঠার সুযোগ দেয়া হয়নি। আমি এত বেশি চিন্তা না করে দ্রুত ট্রেনে উঠে পড়লাম।
আমার সবসময়ই জানালার পাশে বসতে ভাল লাগত। তাই এবারও জানালার পাশের সিটে গিয়েই বসলাম। এমন এক কোনা বেছে নিয়েছিলাম, যেখানে কেউ ছিল না, যাতে ব্যাগটি রক্ষা করতে আরো সুবিধা হয়। ঠিক এমন সময় ট্রেনের ইঞ্জিন আরম্ভ হলো, আর তা যশোরের দিকে অগ্রসর হলো। আমি ক্লান্ত ছিলাম বলে একটু বিশ্রাম নেওয়ার উদ্দেশ্যে শুয়ে পড়লাম। তার ঠিক কিছুক্ষণ পরে আমি কিছু লোকের কথা বলার শব্দ শুনতে পারছিলাম। শব্দ তো এমন লোকাল ট্রেনে প্রায় সময়ই থাকে। তবে গলার কণ্ঠস্বর শুনে চেনাজানা মনে হচ্ছিল। আমি সতর্কতা অবলম্বন করে মুখের উপর একটা কাপড় রেখে শুয়ে পড়লাম। শব্দগুলো ধীরে ধীরে নিকটে চলে আসছিল। মুখে ঢাকা কাপড়ের ফাঁক দিয়ে চেয়ে তাদের একজনের চেহারা দেখতে পেলাম। সেই লোকটা ছিল অ্যাডভোকেট সাহেবের সেই খুনি দলেরই একজন। ঠিক সেই মুহুর্তে আমি বুঝতে পেলাম, আমার সঙ্গে কত বড় একটা ষড়যন্ত্র খেলা হয়েছে। আমি বুঝতে পেলাম এই পৃথিবীতে আমার শেষ সময় এসে পড়েছে। ইহাই ছিল আমার পরিণাম। একজন খুনিকে সহায়তা করার পরিণাম।

আমি এই চিন্তা নিয়েই চিন্তিত অবস্থায় সেখানে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ভাবছিলাম সেই মুহুর্তে কি এমন করা যায়। কিভাবে নিজেকে সেই পরিস্থিতি থেকে বাঁচানো যায়। আমি চাই না আমার মায়ের কোল খালি হতে। আমি চাই না এই অল্প বয়সে মৃত্যু। আমি শুধু কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে, সেখান থেকে বের হতে চাই। এসব চিন্তার মাঝে একবার চিন্তা করছিলাম, "কেননা তাদেরকে টাকার ব্যাগ দিয়ে দেয়া হোক?" কারণ খুব সম্ভবত অ্যাডভোকেট সাহেব তাদেরকে বলেছেন; আমাকে মেরে ফেলে, এই আঠারো কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে ফেলতে। কিন্তু আবার বিবেকে নাড়া দিলো। এত সহজেই হার মেনে নিবো? এত সহজেই সব কষ্ট বৃথা করে ফেলবো? মোটেও না। সংগ্রামী বীরপুরুষ আমি। আমি মরলে, আখরি বারের মতো লড়াই করেই মরবো। কিন্তু লড়াই করার যতো যথাযথ মাধ্যম খুঁজে পাচ্ছিলাম না, বা বলতে গেলে; একজন নিরীহ ব্যক্তি হয়ে, এতজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত খুনিদের কীভাবে পরাজয় করবো? এদেরকে মারতে হলে হয় আমার লাগবে আরো বড়ো মাপের জনশক্তি, নাহয় তাদের সকলকে একইসঙ্গে মারার কোনো বিশেষ উপায়। তৎকালীন সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ল। এক শীতল সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে গেল। সেদিন বাসায় বিদ্যুৎ ছিল না। অ্যাডভোকেট সাহেব আমাকে বললেন, কিছু মজার দেখাবেন। আমি খুবই আগ্রহের সঙ্গে, মনোযোগ সহকারে উনার সামনে গিয়ে বসে পড়লাম। আমাকে বলা হয়েছিল; একটা ব্যাটারি, দুই টুকরো বৈদ্যুতিক তার, একটি পানি ভরা পাত্র, এক বাটি লবণ, একটি ছোট্ট লাইট বাল্ব এবং দুটো সেফটি পিন। সেদিন উনি আমাকে একটি বৈদ্যুতিক সার্কিট বানিয়ে শেখালেন, তাও আবার পানির মধ্যে। সাধারণত পানির মধ্যে বিদ্যুৎ চলাচল করতে পারে না। কিন্তু লবণাক্ত পানিতে বিদ্যুৎ স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে। অ্যাডভোকেট সাহেবের সেই সার্কিটের শিক্ষা আজ তারই বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার সময় এসে পড়েছিল। কিন্তু তার আগে একটা কথা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি ছিল; এরা কি আমার পিছনে পিছনে এখান পর্যন্ত এসেছে, নাকি এরা আগে থেকেই জানতো, আমি কোথায় যেতে পারি। প্রথম ধারণাটি প্রথমদিকে সঠিক মনে হলেও, দ্বিতীয় ধারণাটি আরো বেশি যুক্তিসঙ্গত। কেননা আসার সময় স্টেশনে মানুষ খুবই কম ছিল। ট্রেনের ভিতর থেকেও যাত্রীদের শুধু নামতেই দেখেছি, ট্রেনে চড়তে কাউকেই দেখতে পাইনি। আমার মনে হচ্ছে, এরা নিজেদেরকে দলে দলে ভাগ করে এসব করছে। নাহলে তো শুধু একজন পরিচিত চেহারা দেখা যেত না।

এমন মুহূর্তে আমার উপস্থিত বুদ্ধি ছাড়া আর কিছুই কাজে আসবে না, সেটা আমি স্পষ্টকরে বুঝতে পেরেছিলাম। আমি সব ছেড়ে বৈদ্যুতিক সার্কিটের কথা মনে পড়ার একটি বিশেষ কারণ ছিল। অ্যাডভোকেট সাহেব সেদিন শুধু আমাকে লবণাক্ত পানিতে বৈদ্যুতিক প্রবাহের শিক্ষা দেননি, আমাকে আরেকটি বিশেষ তথ্য দিয়েছিলেন। সেদিন উনি আমাকে বলেছিলেন, "একজন ব্যক্তিকে মেরে ফেলার জন্য বিয়াল্লিশ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক প্রবাহ যথেষ্ট।"
একজন খুনির মুখে এমন তথ্য পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
আমি ট্রেনে আসার পথে একটা মশা মারার রেকেট, তার ব্যাটারি এবং একটা হাতুড়ি নিয়ে যাচ্ছিলাম। আসার পথে মাকে ফোন করে জিজ্ঞাস করেছিলাম কিছু নিয়ে আসতে লাগবে কিনা। মা বলেছিলেন; একটা মশা মারার রেকেট, একটা নতুন হাতুড়ি এবং এক প্যাকেট লবণ। যে মা আমাকে জন্ম দিয়ে এই পৃথিবীতে এনেছিল, যে মা আমাকে জীবন দিয়েছিলেন, সেই মায়ের আদেশ পালনের কারণেই আজ আমার জীবন বাঁচানোর জন্য একটি পন্থা আমার হাতের নাগালে উপস্থিত রয়েছে। কিন্তু এমন এক পরিস্থিতিতে মনে একটি আশঙ্কা বিরাজমান রয়েছে। রয়েছে নীতি নৈতিকতার প্রভাব। নিজেকেই প্রশ্ন করে যাচ্ছিলাম, "এমনটা করা কি ঠিক হবে? কি নিজের জীবন বাঁচাতে অন্যের জীবন নেওয়া ঠিক হবে? যদি আমি প্রকৃতপক্ষে হত্যার বিরুদ্ধেই হয়ে থাকি, তবে আমি নিজেই বা কেন হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হতে যাবো?" একদিকে আমার মস্তিষ্ক আমাকে বাঁচার স্বার্থে মারার বুদ্ধি দিয়ে যাচ্ছিল, আর অপরদিকে আমার মন আমাকে অন্যের জীবন নেওয়ার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করছিল। মন এবং মস্তিষ্কের এই সংঘর্ষে শেষমেশ মস্তিষ্কই জয়লাভ করেছিল। কারণ মস্তিষ্কের এমন একটাই প্রশ্ন ছিল, যার উত্তর না পাওয়ায় মনের সকল যুক্তি বাতিল হয়ে গিয়েছিল। সেই মুহুর্তে আমি সিদ্ধান্তে এলাম; আমি বেঁচে গেলে একটি পরিবারের কল্যাণ হবে, কিন্তু তারা বেঁচে থাকলে আরো অসংখ্য পরিবারের ক্ষতি হবে। আজ যদি তারা বেঁচে, আমাকে মেরে, এই টাকা নিয়ে চলে যায়; তাহলে সেই অহংকারী লোকের অহংকারেরই জয় হবে। জয় হবে এমন এক মানুষের, যে মনে করে; পৃথিবীর সবই তার যুক্তির কাছে তুচ্ছ।
অ্যাডভোকেট সাহেব, আজ আমি বাঁচবো। শুধু নিজের ইচ্ছার খাতিরে নয়, আপনার চোখের সামনে থেকে পট্টি সরানোরও উদ্দেশ্যে।
মনে কিছু নিবেন না, অ্যাডভোকেট সাহেব। এবার আমি আর আপনার অধীনস্থ সেই চাকর নই। এই নতুন চিন্তাচেতনার উদ্ভাবন আপনিই ঘটিয়েছেন। এর সব দায়ভার একা আপনার। এর স্বাদ সর্বপ্রথম দিতে যাচ্ছি আপনার এই পোষা হায়েনাদের।
অতঃপর আমি কাজে লেগে পড়েছিলাম। আমার কাছে এক বোতল পানিও ছিল। পানির সঙ্গে সেই এক প্যাকেট লবণ মিশিয়ে নিলাম। সেই লবণাক্ত পানি নিচে মেঝেতে ছড়িয়ে, ফেলে দিলাম। লবণাক্ত পানি ছড়িয়েছিলাম শুধু আমার সিটের পাশের জায়গা পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলাম, যেন আমার পায়ে স্পর্শ না করতে পারে। আমার কাছে যে মশা মারার রেকেটটা ছিল, সেটার উপরিভাগের প্লাস্টিক অংশটুকু হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে, তারগুলিকে বের করা নিলাম। এরপর এতে ব্যাটারি লাগিয়ে, নীচের দিকে মুখ করে দিয়ে, যেন তা লবণাক্ত পানিতে স্পর্শ করে। চালু করার সুইচটা রাখলাম আমার হাতের পাশে। আমার পরিকল্পনা অনুসারে, যেমনিই তারা আমাকে চিনতে পেরে আমার কাছে আসবে, ঠিক তেমনিই আমি সুইচ চেপে তাদের মেরে ফেলবো। এই আশায় সেখানে বসেছিলাম মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে, খুবই সুসপষ্টভাবে নিজের চেহারা দেখিয়ে। আমার শার্ট খুলে, রেকেটটা ঢেকে রেখেছিলাম। ঠিক আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী, তারা আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পেয়ে, আমার কাছে হেঁটে আসছিল। আমি খুবই স্বাভাবিক ভাবে সেখানে বসেছিলাম। কাউকে না চেনার ভাণ করছিলাম। কিন্তু আমাকে দেখাতে তারা আমার দিকে আক্রমণাত্মক উদ্দেশ্যে আসেনি। তাদের মধ্যে আমাকে চিনতে পেরেছিল শুধু সেই লোকটা, যাকে আমি সেই দল থেকে চিনতে পেরেছিলাম। লোকটা আমার কাছে এসে জিজ্ঞাস করলো, "এই! তুমি এই ট্রেনে কি করছো?"
"আমি তো আমার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম।"
"ওঃ! তুমি আশেপাশে কোনো জুয়ান, সুন্দরী মেয়েকে দেখেছো?"
আমি শুনে খুবই অবাক হলাম। খুবই তাজ্জব করার মতো প্রশ্ন। আমি সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, "না তো! কেন?"
"উকিল সাহেব পাঠিয়েছেন ঐ মেয়েটাকে খুঁজতে। অনেক জরুরি।"
"কিসের জন্য? কি করেছে মেয়েটা?"
"মেয়েটার ফোনে একজন মক্কেলের বিরুদ্ধে কিছু গোপন তথ্য আছে। সেগুলো মেটাতে আমাদের পাঠিয়েছেন।"
"তথ্যগুলো মেটানোর পর আপনারা মেয়েটিকে কি করবেন?"
"উকিল সাহেব তো বলেছিলেন, চলতি ট্রেন থেকে ফেলে দিতে। সেটাই করবো।"
তখন বুঝতে পেলাম, এর জন্যই তারা ট্রেনে প্রথমবার আমার ঢাকা চেহারা দেখেও এড়িয়ে গিয়েছিল কেন। কেননা এদের তো উদ্দেশ্য কোনো পুরুষকে খোঁজার ছিলই না, ছিল তো সেই মেয়েকে খোঁজার।
কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য নিজের প্রাণের জন্য তৃপ্তি পেলেও, সেই মেয়েটির জন্য খুব চিন্তা হচ্ছিল। এরা সেই বেচারির সঙ্গে কি কি করার নিয়ত রেখেছে, তা একমাত্র আল্লাহ্ জানেন। কিছুক্ষণ আগেই যাদেরকে মেরে ফেলার জন্য নিজের মনকে রাজি করেছিলাম, তাদের মারার প্রতি আগ্রহ কমে গিয়েছে। ঠিক এভাবেই আমার মানসিক দুর্বলতা আমাকে কখনও জীবনে আগে বাড়তে দেয়নি। কারণ লক্ষ্য তো জীবনে অনেক ছিল, কিন্তু তা পূরণ করার মতো আত্মবিশ্বাস আমার মধ্যে আদৌ বিদ্যমান নেই।
কিন্তু একজন নিরীহ ব্যক্তি একই ট্রেনে উপস্থিত রয়েছে, তাও আবার একটি মেয়ে; শুনে আমার টনক নাড়া দিয়ে উঠল।
মনের ভেতর দিয়েই আওয়াজ আসলো, "আজ হয় এই মেয়েকে বাঁচাবো, নাহয় এর লজ্জায় মরে যাবো। যেমনিই হোক, তাকে যেকোনো অবস্থায় আজ বাঁচাতেই হবে।"
যেই ফাঁদ তৈরী করেছিলাম নিজের জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে, সেই ফাঁদ ব্যবহার করে এখন আরেকজনকে বাঁচানোর চেতনা মনের মধ্যে জেগে উঠল। তারা তখনও সেই স্থানেই দাঁড়িয়ে ছিল। এই সুযোগ দেখে, আমি রেকেটের সুইচ চাপ দেয়ার উদ্দেশ্যে হাত দিয়ে রেকেট কষে ধরলাম। ঠিক তখনই দেখি তাদের একজন বলে উঠল, "ওস্তাদ! মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। ঐযে ওখানে।" বলেই ট্রেনের পেছনের দিকে দৌড় দিল। তার সহকর্মীরা তার পেছনে পেছনে দৌড় দিয়ে, মেয়েটার মুখ চেপে, ধরে নিয়ে আসলো। মেয়েটি ছোটার জন্য অনেক নাড়াচাড়া করছিল। মেয়েটির অবস্থা দেখে, তাদের উপর প্রচুর জিদ চড়ছিল আমার। মন চাচ্ছিল তাদের এখনই মেরে ফেলি। কিন্তু মেয়েটি তাদের সংস্পর্শে ছিল। তাই এমতাবস্থায় কিছু করলে, মেয়েটাও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি কিছুক্ষণের জন্য চুপসে বসে রইলাম। তারা মেয়েটির ব্যাগের মধ্যে তার ফোন খুঁজছিল। সেই মুহুর্তে আমার চোখ পড়ল তার চেহারায়। খুবই মায়াবি চোখ ছিল মেয়েটার। এমন মায়াবি চোখ বিশিষ্ট মেয়েকে কেমন অযত্নে ধরে রেখেছিল তারা! দেখে তো তাদের প্রতি আমার ক্রোধ অত্যাধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছিল। তখন আমার মাথায় একটি বুদ্ধি এলো। এমন বুদ্ধি মূলত আমার নয়। এ বুদ্ধি আমি শিখেছিলাম অ্যাডভোকেট সাহেবের কাছ থেকে।
আমি প্রথমে আমার পরিচিত লোকটাকে ডেকে জিজ্ঞাস করলাম, "আচ্ছা ভাই, অ্যাডভোকেট সাহেব তো শুধু এর মোবাইল চান। শুধু ঐটা নিয়ে উনার কাছে পৌঁছে দিলে চলবে না?"
খুবই অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন, "মাথা ঠিক আছে তো? মেয়েকে এমনিই ছেড়ে দিলে তো সে সবাইকে সবকিছু বলে দিবে।"
"কিন্তু সে হঠাৎ করে গুম হয়ে গেলে, এর সন্দেহ তো সর্বপ্রথম অ্যাডভোকেট সাহেবের সেই মক্কেলের উপরেই আসবে। তো এখন আপনিই ভেবে দেখুন, কি করা উচিত।"
"উকিল সাহেব থাকতে চিন্তা কিসের? আমাদের কাজ তো শুধু উনার আদেশ পালন করা।"
"আরে ভাই, এটা কোনো কথা বললেন? উনিও তো একজন মানুষ, তাই না? ভুলত্রুটি তো উনার দ্বারাও হতে পারে।"
"কেমন ভুলত্রুটি?"
"এই যে, আপনারা এখন মেয়েটিকে মেরে ফেললেন, তারপর লম্বা তদন্ত হলো, জানা গেল যে মেয়েটা ট্রেনে করে যাচ্ছিল, ট্রেনে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু নামেনি। এগুলোর বড়সড় তদন্তে ধরা পড়বে সেই মক্কেলটা, আর তার ঠিক পর আপনারা।"
"আমরা কেন? আমরা তো মক্কেলের আদেশে এগুলো করিনি।"
"ঠিক! কিন্তু মামলার তদন্তে অ্যাডভোকেট সাহেব আপনাদের সঙ্গে কথোপকথনের ব্যাপার যদি পুরোপুরি অস্বীকার করে দেন, তবে কি আদৌ কিছু করতে পারবেন? নিজের সঙ্গে উনার পরিচয় প্রমাণের কোনো উপায় আছে?"
আমার প্রশ্নটা শুনে লোকটা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। তখনই আমি বুঝতে পারলাম, আরেকটু বারি দিলেই লোকটা পুরোপুরি মেনে নিবে। আমি আর সময় অপচয় না করে বললাম, "দেখুন। আপনার কোনো ধরনের উত্তর আইনের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই আমি বলছি, মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রাখতে। পরবর্তীতে একে পাগল প্রমাণ করে, মামলাটা অন্যভাবে জিতা সম্ভব হবে।"
লোকটা কিছুক্ষণ ভেবে, আমার দিকে চেয়ে, হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে, বললো, "হুম! তোমার কথায় যুক্তি আছে। এই মেয়েকে এত সহজে মেরে ফেলাটা বোকামি হবে।"
আমি মুচকি হেসে বললাম, "তাহলে মেয়েটিকে আমার সিটের পাশে বসিয়ে দেন। আমি তাকে পাহারা দেই।"
"কিন্তু তার মুখ ছেড়ে দিলে তো সে চিৎকার মেরে উঠবে।"
আমি বাম হাত আগে করে, ইশারার মাধ্যমে, আমার পাশের লোকটার চাকু চেলাম। সে আমার ইশারা বুঝতে পেরে, আমার হাতে চাকুটা দিল। আমি সেই চাকু হাতে নিয়ে বললাম, "সে চিৎকার করলে, আমি তার গলায় আঘাত করবো। চিন্তার কোনো বিষয় নেই।"
"কিন্তু তাকে তো মেরে ফেলা যাবে না।"
"গলায় আঘাত করবো তার কণ্ঠনালীতে। তাহলে সে অন্তত চিৎকার দিতে পারবে না। বাকিটা পথ তার রক্তঝরা স্থানে চাপ দিয়ে নিয়ে গেলে, সে নিঃসন্দেহে বেঁচে যাবে।"
"পরে তার চিকিৎসা করতে গেলে কি বলবো?"
"বলবো, এই পাগল মেয়েটা নিজের কণ্ঠনালী কেটে ফেলেছে।"
"হা হা হা! বেশ! বড়ই চতুর একজন ব্যক্তি তুমি।"
"হা হা হা! সব অ্যাডভোকেট সাহেবেরই শিক্ষা।" বলে আমি মেয়েটাকে আমার পাশে এনে বসালাম। ভয়ে তার শরীর কাঁপছিল। আর একটা মুহূর্তও অপচয় করার মতো ছিল না। আমি মেয়েটার কানের কাছে গিয়ে, ফিসফিস করে বললাম, "বাঁচতে চাইলে পা দুটো মেঝে থেকে উপরে তুলে নাও।" এটা বলেই চোখ মারলাম। মেয়েটি আমার ইশারা বুঝতে পেরে, পা দুটো তুলে, সিটের উপর বসে পড়ল। আমার পা দুটো আগ থেকেই কাঠের সিটের উপরে ছিল। তার পা দুটো ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি সুইচে চাপ দিয়ে দিলাম। আর প্রায় তিন থেকে চার মিনিট শুধু তাদেরকে এই বৈদ্যুতিক ঝটকা দিতে থাকলাম। যেই হত্যাকারীরা এতদিন অন্য মানুষদের হত্যা করে বেড়াতো, তারাই সেদিন আমার হাতে হত্যা হলো। কিন্তু এ দৃশ্য দেখে আমার পাশে বসা মেয়েটা অত্যাধিক মাত্রায় ঘাবড়ে গিয়েছিল। ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। হত্যা তো এমন কিছু না, যা একজন সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত দেখে থাকে। তার আতঙ্কিত চেহারা দেখে আমার নিজেরও খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু আবার মেঝেতে তাকিয়ে ভাবলাম, কিছু বলা উচিত। বেচারি এখন চমকে আছে। কিছু বললে হয়তোবা আতঙ্ক কিছুটা কমবে।
এ চিন্তা মাথায় রেখে কিছু বলতে নিলাম, কিন্তু ঠিক এমন সময়, মেঝেতে পড়া দেহগুলির মধ্যে একজন সামান্য কাঁসি দিয়ে চোখ খোলার চেষ্টা করছিল। আমি আবার বৈদ্যুতিক ঝটকা দেয়ার উদ্দেশ্যে হাতে থাকা রেকেট নিচে রাখতে গেলে মেয়েটি আমাকে নিজ হাতে থামিয়ে দেয়। আমি অবাক হয়ে তার পানে তাকিয়ে রয়ে গেলাম। সে হাত দিয়ে ইশারা করে আমাকে থামতে বলে। আমি ওখানেই বসে থেকে দেখলাম; মেয়েটা সিট থেকে নেমে, সেই লোকটার গলার উপর নিজের হিল জুতো দিয়ে নিজের শরীরের সমস্ত ওজন দিয়ে চড়ে দাঁড়ালো। এ দৃশ্য দেখে মনে কিছুটা ভয় পেলেও, চেহারায় কেমন এক নির্লজ্জ মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। আমি তো যেমন মুগ্ধই হয়ে গেলাম। কিন্তু তার ঠিক পরপরই মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে। তখন বুঝতে পেলাম, মেয়েটি যা করেছিল তা ছিল মনের ক্ষোভ মেটানোর এক দুর্দান্ত উদ্দেশ্যে। তার চোখ থেকে প্রথম অশ্রুর ফোঁটা মেঝেতে পড়ার আগেই আমি নিজের গামছা আগে বাড়িয়ে দিলাম। আমার এই কাণ্ড থেকে সে কিছুক্ষণ আমার চোখের দিকে মায়াবী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, "ধন্যবাদ। অনেক অনেক ধন্যবাদ।"

Wednesday, July 24, 2019

গোয়েন্দা নিজামুল

গোয়েন্দা নিজামুল

এক রাত প্রায় ১১:২৫ এর দিকে আমি প্রতিদিনের মতোই আমার টিউশনি শেষ করে বাসায় ফিরছিলাম। বাসায় যেতে অনেকটা দেরি হয়েছিল কারণ সেদিন টিউশনি শেষ করে বের হবার সময়, অন্ধকার পথে চলতে গিয়ে, হোঁচট খেয়ে আঘাত পাই। সেই আঘাতের ফলে আমাকে কিছুক্ষণ সেখানেই ফার্মাসি খুঁজে, মলম-পট্টি করতে হলো। আমি সড়ক পাড় করার সময়, আমার হাঁটাচলার ধারণ দেখে, সড়কের পাশের টঙ্গের সামনে পুলিশ আমাকে কাছে ডাক দিলো। আমিও ভদ্রলোকের মতো তাদের ডাকের সাড়া দিয়ে, তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করলাম কি হয়েছিল। কিন্তু আমার কোনো কথার উত্তর না দিয়েই, আমার দেহ অনুসন্ধান করতে লাগল। অনুসন্ধানের ফলে তারা আমার প্যান্টের পকেটের ভেতর একটি ইয়াবার প্যাকেট পেল। আসলে, এটা তারা খুঁজে পায়নি, তারা নিজেই সেই প্যাকেটটা আমার পকেটের ভেতর, সুপরিকল্পিতভাবে রেখেছিল। এই দৃশ্য দেখার পর আমি চরম ভাবে আতঙ্কিত হয়ে গেলাম। আমার চেহারার মধ্যে তা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছিল। অতঃপর তারা আমাকে হাতকড়া পড়িয়ে, তাদের পুলিশের গাড়িতে উঠতে বললো। আমি সাহস জুটিয়ে, কিছুটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করায় আমার গালে কষিয়ে এক চড় লাগানো হলো। নিজেকে এই এমন সময়ে, এমন অসহায় অবস্থায় দেখে, আমার মাথা কাজ করছিল না। আমি গাড়ির মধ্যে বসেছিলাম তাদের চা-সিগারেট শেষ হবার অপেক্ষায়। আমি গাড়িতে উঠার ৫-৭ মিনিট পরেই, টঙ্গে বসা দুজন বালক এসে পুলিশদের সঙ্গে, আমার সম্পর্কে তর্কবিতর্ক করতে লাগল;

- জ্বি অফিসার, আপনাদের সঙ্গে একটি বিষয়ে কিছু আলোচনা করার ছিল। আপনাদের কিছু মূল্যবান সময় পেতে পারি?
- কোন বিষয়ের কথা বলছেন? কে আপনারা?
- আমি প্রথমে প্রশ্ন করেছি, আপনে আগে তার জবাব দিন।
- আগে আপনে নিজের পরিচয় দিন।
- আমার পরিচয়; নিজামুদ্দিন আলম ওরফে নিজামুল। আমি একজন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ুয়া ছাত্র। কিন্তু এগুলো তো আমার সাধারণ পরিচয়। আপনি তো মূলত আমার রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক ক্ষমতার কথা জানতে চাচ্ছেন। অর্থাত্, আমার সঙ্গে আপনার কথা বলার সুরটা কেমন হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে আমি বলতে চাই, আমার নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকলেও, অনেক রাজনৈতিক কর্মকর্তা আমাকে চিনে থাকে। কিন্তু সে পরিচয়টা আপাতত গোপন রাখা হোক। আমি এবার আপনাদের কিছু খুবই সরল-সোজা প্রশ্ন করব আর আপনি খুবই সরল-সোজাভাবে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিবেন।
- আপনি এতক্ষণ যা কিছু বলেছেন, তার অধিকাংশ তথ্যই অপ্রয়োজনীয় এবং সময় অপচয়ী। তাই আমরা আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিব না।
- শুনুন, অফিসার সাহেব, আমার পরিচয়টা চিরকালের জন্য গোপন রাখার কোনো উদ্দেশ্য নেই আমার, কিন্তু আপনার জানার আগ্রহটা, আপনার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা অস্থিরতা প্রকাশ করছে। আপনার মনে এখন কতটা সংকোচ হচ্ছে, সেটা আপনার ভাবভঙ্গি দ্বারা প্রকাশ করছেন।
- কেমন ভাবভঙ্গির কথা বলার চেষ্টা করছেন আপনি?
- আমার পরিচয় অনেক রাজনৈতিক কর্মকর্তা জানার ব্যাপারটা বলার কিছু সময় আগ পর্যন্ত আপনার ঘাড় আরাম করে নয়ে, সামান্য হেলান দিয়ে ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের কথা ওঠানোর পর থেকেই দেখছি, আপনার ঘাড় আর আরামে হেলান দিয়ে নেই, এখন সেটি একটি সতর্ক সোজা আকৃতি ধারণ করেছে। অর্থাত্, আপনার মনে সংকোচ হচ্ছে, আমি যদি আপনার কোনো বড়সড় ক্ষতি করে বসি। কি, ঠিক বললাম কিনা?
- এসব অযৌক্তিক আলাপ-আলোচনা অন্য কারো সঙ্গে করেন।
- আপনার কাছে অযৌক্তিক লাগতেই পারে। আমার কাছে আপনার একটা বৈশিষ্ট্য খুবই অযৌক্তিক লেগেছে, আর সেটা হলো ঐ নির্দোষ ছেলেটিকে, সুপরিকল্পিত ভাবে আটক করার ব্যাপারটা।
- কাউকেই সুপরিকল্পিত ভাবে আটক করা হয়নি। আপনার কথাটি সম্পূর্ণরূপে ভিত্তিহীন। আমরা তার প্যান্টের পকেট থেকে এই ইয়াবার প্যাকেট পেয়েছি। সে একজন প্রমাণিত অপরাধী, তাই তাকে আটক করা হয়েছে।
- প্রমাণ আমার কাছেও একটি রয়েছে। কিন্তু সেটা প্রদর্শন করার পূর্বে আমি একটা কথা জানতে চাই। সেটা হলো, আপনার পুলিশের ট্রেইনিংয়ের সময় মনে হয় আপনাকে শেখানো হয়নি।
- কিসের কথা বলছেন।
- আপনি কি এতটুকু শেখেননি যে, অপরাধীর কাছে কোনো প্রকারের প্রমাণ পেলে, তাকে পকেটে না রেখে, একটা আলাদা প্যাকেটে রাখতে হয়? এটা তো কখনওই হতে পারে না, যে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আপনার ট্রেনিংয়ের সময়ে শেখানোই হয়নি। তাহলে আপনিই বলুন, আপনার ট্রেনিং কি আদৌ পুলিশেরই ছিল, নাকি অন্য কোন কিছুর ছিল?
- আমাদের কাছে আজকের মতো আলাদা প্যাকেট শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে আমি এটা আমার পকেটের ভেতর সুরক্ষিতভাবে রেখেছি। থানায় গিয়ে, সেখান থেকে প্যাকেট নিয়ে, প্যাকেটে ভরে, রেখে দিব।
- তাই নাকি? কারণ আমি তো জানি, এই ছেলেটা এখানে আসার আগে থেকেই আপনার কাছে এই ইয়াবার প্যাকেটটি রয়েছে।
- কি আবল-তাবল বোকছেন? আমার কাছে এটা আগে থেকেই থাকবে কিভাবে? আমি তো এটা সেই ছেলেটার পকেট ঘেঁটে খুঁজে পেয়েছি।
- আমি যদি বলি, আমার কাছে প্রমাণ আছে, তাহলে কি বলবেন?
- কি ধরনের প্রমাণ?
- প্রমাণ দেখতে চান? দাঁড়ান!

প্রমাণ চাওয়ায়, পকেট থেকে ফোন বের করে, নিজামুল সেই পুলিশ অফিসারকে তাদের কুকীর্তির ভিডিও ফুটেজ দেখায়। সে ফুটেজটি দেখে পুলিশ অফিসারটি দ্রুততার সঙ্গে নিজামুলের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে, ফোন থাপা দিতে নিল। কিন্তু তখনই নিজামুল সেই পুলিশ অফিসারকে জানালো, যে ফোনটা নিয়ে কোনো লাভ নেই, কারণ ফুটেজটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো দ্বারা ছড়িয়ে পড়েছিল। ইতিমধ্যেই প্রায় ৬৬৯৭ টি ভিউ হয়ে গিয়েছিল। যার মধ্যে দর্শক ছিল অনেক উচ্চ পদের সরকারি এবং রাজনৈতিক কর্মকর্তারাও। নিজামুলের এই কান্ড দেখে পুলিশ অফিসার তাকে প্রাণের হুমকি দেয়। তখনই চারিদিক থেকে সাইরেন বাজার আওয়াজ আসতে লাগল। পুলিশের একটি ফোর্স কিছুটা দূরত্ব থেকে সবকিছু শুনছিল নিজামুলের ব্যাগের ভিতরে থাকা ফোন থেকে। সেই দুজন পুলিশ অফিসারকে হাতেনাতে ধরার জন্য, নিজামুলকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাটি সেখানেই শেষ হয়নি। নিজামুল সেই পুলিশ অফিসারকে আদেশ দিল আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে, হাতকড়া খুলে, সবার সামনে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে। ব্যাপারটা দেখে আমি যদিও প্রথমে আশ্চর্য হই, পরবর্তীতে তার চোখের দিকে তাকানোতে তার মনের প্রকৃত ভাব কিছুটা বুঝতে পেলাম। তার রক্ত চড়া চোখ আর অতিরিক্ত চওড়া মুচকি হাসি দেখে তার মনের বিকৃত গঠন অনেকটা বোঝা যায়। ততক্ষণে সে সেখানে উপস্থিত সকল পুলিশ অফিসারকে বললো আবার একটি দুরত্বে গিয়ে অপেক্ষা করতে। অতঃপর তারা সেখান থেকে কিছু সময়ের জন্য নিজের পূর্ববর্তী স্থানে ফিরে চলে যায়। তারপর সে নিজের বন্ধকে বলে, "ব্যাগ থেকে হাতুড়িটা বের কর্ আর লাইভ ভিডিও রেকর্ড কর্" এটা শুনে তার বন্ধু ব্যাগ থেকে হাতুড়ি বের করে তার হাতে দিল এবং মোবাইল ফোনে লাইভ ভিডিও রেকর্ড করা শুরু করলো। নিজামুল সেই পুলিশ অফিসারকে ঐ টংয়ের বেঞ্চের মধ্যে বসালো। পুলিশ অফিসারটি ভয়ে কাঁপছিল এবং কাঁপতে কাঁপতে বার বার ক্ষমা চাচ্ছিল। তার পায়ের কাঁপুনি এবং নিজামুলের চেহারার ভয়ঙ্কর হাসিটা দেখে এক মুহূর্তের জন্য আমার নিজেরই ভয় করছিল। নিজামুল হাতুড়িটা হাত থেকে রেখে, নিজের পকেট থেকে সার্জিক্যাল গ্লাভস বের করে পড়ল। তারপর হাতুড়িটা আবার হাতে নিয়ে, আমাকে কাছে ডেকে বললো, "সে তোমার গালে থাপ্পড় মেরেছে, তুমি আঘাত পেয়েছ, এবার তুমিও তার গালে ইচ্ছামতো থাপ্পড় মারো। আর হ্যাঁ, ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে থাপ্পড় মারবা, যাতে সবাই অন্যায়ের শাস্তির একটা ধারণা পেতে পারে।" এটা শুনে আমি বললাম, "না, থাক্! সে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে, আমিও ক্ষমা করে দিয়েছি।" আমার এই উক্তি শুনে সে এতো জোড়ে জোড়ে হাসতে লাগল, যে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে মজার কৌতুক শুনেছেন মহাশয়। এমন বিরাট মাত্রায় হাসতে হাসতে হঠাত্ করে পুলিশ অফিসারের হাতে হাতুড়ি দিয়ে জোড়ে আঘাত করলো। আঘাত করামাত্র পুলিশ অফিসারটি চিত্কার করে উঠল এবং আমি ভয়ে পেছনে চেপে গেলাম। তার প্রথম আঘাতের ফলে পুলিশ অফিসারের হাত ভেঙে গেল, কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়নি। প্রথম আঘাতের পর সে পুলিশ অফিসারকে তার আরেক হাত আগে বাড়াতে বললো। পুলিশ অফিসারটি ভয়ের চোটে ছটফট করে পিছনের দিকে পলায়নের চেষ্টা করছিল। কিন্তু নিজামুল সে অফিসারের আরেক হাত মুহূর্তের মধ্যেই থাপা দিয়ে ধরে নিল এবং তা বেঞ্চের উপর রেখে আবার আঘাত করল। পুলিশ অফিসারটির উভয় হাত থেকে অধিক পরিমাণের রক্তপাত হচ্ছিল। এই দৃশ্য দেখার পর আমি পুলিশ অফিসারের জন্য আফসোস করছিলাম। আমার চেহারায় তার প্রতি ফোটে উঠা মায়া দেখে নিজামুল আমাকে বললো, "শুনো, যার প্রতি তুমি সহানুভূতি দেখাচ্ছ, তার কারণেই অসংখ্য গরীব এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের নির্দোষ সন্তানদের জেলে যেতে হয়েছে, তাদের পরিবারকে লজ্জিত হতে হয়েছে, তাদের নামের মধ্যে 'অপরাধী' নামক দাগ পড়েছে, তাদের কেউও কখনও সিভিল সার্ভিসে যোগদানের স্বপ্ন দেখতে পারবে না, অনেক যুবকের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হবে, অনেকে তো এই অভিশপ্ত ঘটনার জন্য মানসিক রোগী হয়ে বিভিন্ন অনৈতিক পথ অবলম্বন করবে; সেগুলোর জন্য দায়ী শুধু এই মানুষরূপী পশুটি। আজ এই লোকটা তোমার জীবনটাও নষ্ট করতে নিয়েছিল, কিন্তু মহান আল্লাহ্ তা'আলা তোমাকে এর নোংরা হাত থেকে তোমায় বাঁচিয়েছেন। আজ আমি এই মিশনে এসেছিলাম ডিপার্টমেন্টকে একটি শর্ত দিয়ে, যে আমি যদি এই অফিসারকে হাতেনাতে ধরতে পারি, তাহলে তার সঙ্গে যা ইচ্ছা করতে পারব, অর্থাত্ এই ব্যাক্তির জীবনের কি হবে না হবে, সেটা আমিই সিদ্ধান্ত নিব।" উক্তি শুনে পুলিশ অফিসারটি সেই দুটো রক্তাক্ত হাত জোড় করে, তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করল। এটা দেখে নিজামুল তার চেহারার দিকে তাকিয়ে একটা বড় করে মুচকি হাসি দিল এবং ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, "সে সকল দর্শক এখন ভিডিওটি দেখছেন আর যে সকল দর্শক এটা ভবিষ্যতে দেখবেন, তাদের উদ্দেশ্যে অল্প কিছু কথা বলতে চাই। আমি হলাম একজন গোয়েন্দা অফিসার। আমি ঠিক এই লোকটার মতোই একজন আইনের লোক। কিন্তু এখানে সামঞ্জস্য রয়েছে শুধু আমাদের পেশার শ্রেণী ও ধরণ, তাছাড়া অন্য কোনো ব্যাপার নয়। আমি আজ শাস্তি দেয়ার জন্য কিছু আইন বিরোধী পথ অবলম্বন করে থাকলেও, এমনটা করার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। আমি অন্যায় এবং অবিচারকে প্রচুর ঘৃণা করি। আর যখন চোখের সামনে দেখতে পাই, আইনের রক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া কর্মীরা নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করছে। খুবই কষ্ট লাগে আমার কাছে, যখন রক্ষক হয়ে পড়ে ভক্ষক। এই লোকটা শুধুমাত্র নিজের স্বার্থের জন্য এতগলো নির্দোষ যুবকদের উপর আরোপ লাগিয়েছে, গায়ে হাত তুলছে, মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে এবং অসংখ্য জীবন নষ্ট করেছে। আজ তাকে একটা উচিত শাস্তি হিসেবে এই পন্থা বেছে নিয়েছি। এটা আমি প্রকাশ্যে করছি, যাতে দেশের জনগণ উক্ত বিষয়ের মাধ্যমে আরো সচেতন হয়ে উঠতে পারে। আমি সবাই দেখাতে চাই, আইন মরে যায়নি। পৃথিবীতে এখনও আইন মেনে চলার মতো এবং আইনের অবমাননার ফলে শাস্তি দেয়ার মতো মানুষও বেঁচে আছে। তার এই দুই হাত দিয়ে সে অসংখ্য মানুষকে কষ্ট দিয়েছে, তাই হাতকে আমি ভেঙে ফেলেছি, নাহলে ভবিষ্যতে এই হাত দিয়ে আরো অনেক জীবন নষ্ট করে বেড়াবে।" তার কথাগুলো শুনার পর থেকে আমার জীবনে এক নতুন লক্ষ নির্ধারণ করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম একদিন স্বয়ং একজন পুলিশ অফিসার হয়ে মানুষের কল্যাণ করব। কারণ যে দেশের মধ্যে অনৈতিক পুলিশ অফিসার ভরপুর পরিমাণে রয়েছে, সেই দেশের মধ্যে কিছু সত্ কর্মকর্তাদের প্রয়োজন রয়েছে।
ধন্যবাদ গোয়েন্দা নিজামুলকে,
ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা।

Monday, July 8, 2019

ফারিহা

fariha
Fariha


আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে, আজকের তারিখে, ফেসবুক নামক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের কথা শুরু হয়েছিল। বারোটা মাস ধরে অনলাইনে এতো কথার পরও আমরা কখনও মুখোমুখি দেখা করার সুযোগ পাইনি। এই আমার দেখা প্রথম মেয়ে, যার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার ছয় মাসেরও বেশি হয়ে গেলো, কিন্তু এখনও আমার প্রেমে পড়েনি। জানি না ব্যাপারটা শুনতে কেমন লাগে। কিন্তু আমি নিজেই আজে তাকে সব সত্যি সত্যি করে বলে দিব। আর সহ্য হচ্ছে না আমার। আর কতো অপেক্ষায় থাকবো। আজ পর্যন্ত ছেষট্টিটা মেয়ের কাছ থেকে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি। তাদের মধ্যে একটাও আমার রুচির মতো ছিল না। এই জীবনে প্রথম একটা মেয়ে এতটাই পছন্দ হয়েছে, যে আমার নিজেও বিশ্বাস হচ্ছে না। সেও বাকিদের মতো নিজে নিজেই আমার প্রেমে পড়বে, এই অপেক্ষায় থাকতে থাকতে আমি নিজেই তার প্রেমে পড়ে গেলাম। আর দেড়ী নয়। এই সুযোগটা হাতছাড়া করা আমার জন্য খুব বিরাট এক বোকামি হবে।

এটাই চিন্তা করতে করতে বাসায় এলাম। আমাদের বাসা পুরাণ ঢাকার লালবাগ এলাকায়। আমি সবসময় দেড়ী করেই বাসায় আসি। এখন সময় প্রায় রাত সারে বারোটার মতো। ফোনের মধ্যে মোটেও চার্জ নেই। যতক্ষণ বাসায় থাকি, ততক্ষণ ফারিহার সঙ্গেই কথা বলতে থাকি। যখন বাহিরে বের হই, তখনও সারাদিন-সারারাত তার সঙ্গেই কথা বলতে থাকি। তাই দিন শেষে এক ফোঁটা চার্জও থাকে না। যতটুকু চার্জ দেয়া হয়, রাতেই দেয়া হয়। আজ তো আমার পাওয়ারব্যাংকের চার্জও শেষ হয়ে গেল। এতটাই কথা বলি আমরা সারাটা দিনে। বাসার মধ্যে ভাইয়া ছাড়া কেউও ফারিহার প্রসঙ্গে জানে না।

ভাইয়া বিদেশ থেকে আসার এক সপ্তাহ হলো মাত্র। এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচটা মেয়ে দেখে ফেলেছে। তাদের মধ্যে একটাও ভাইয়ার পছন্দ হয়নি। ভাইয়া আর আমার পছন্দ-অপছন্দ প্রায় একই রকম। ভাইয়া যখনও নিজের জন্য কিছু কিনতে যেতো, তেমনই একটা আমার জন্যও নিয়ে আসত। ভাইয়া এমন কিছু কিনত না, যেটার একটা আমার জন্যও নেয়া যাবে না। ভাইয়া আমাকে যতটা ভালবাসে, তার চেয়ে বেশি কেউ আমাকে ভালবাসতে পারবে কিনা, তা সন্দেহ। কিন্তু এতো ভালবাসা সত্বেও আমি কখনও ভাইয়ার অর্জনগুলোর ধারেকাছেও যেতে পারিনি। বাবা সবসময় ভাইয়ার ব্যাপারে একটাই কথা বলতেন, "পৃথিবীতে আকর্ষণীয় পুরুষ হয় দুই প্রজাতির; একটা হলো হ্যান্ডসাম, আরেকটা হলো স্মার্ট। আল্লাহ্ তা'আলার অশেষ রহমতের ফলে আমার বড় ছেলে তানজিল সেই অত্যন্ত সচরাচর তৃতীয় প্রজাতির, যে প্রজাতির পুরুষ সব দিক দিয়েই পরিপূর্ণ।" যখনও বাবা এই কথাটা বলতেন, তখন আমি নিজেকে খুবই অসহায় মনে করতাম। কারণ আমার মধ্যে উভয় গুণাবলির মধ্যে কোনটাই শুরু থেকে ছিল না ভাইয়ার মতো। আমি আজ যতটা স্মার্ট, তা ভাইয়ার দেয়াই শিক্ষা। দুর্ভাগ্যবশত, হ্যান্ডসাম হওয়ার রহস্য ভাইয়া তো কি, পৃথিবীর কেউও কাউকে শেখাতে পারবে না।

আজ বাসায় গিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে। কারণ সকালে চাচাতো ভাইরা আসবে। দুপুর তিনটার দিকে নাকি মেয়ে পক্ষের বাসায় পৌঁছাতে হবে। অর্থাৎ, আমাদের বাসা থেকে প্রায় একটার দিকে বের হতে হবে। শুনেছি তাদের পরিবারও আমাদের পরিবারের মতো খুবই উঁচু বংশের। তারাও তৎপরতা খুবই পছন্দ করে। তাদের ব্যাপারে শুনে আমাকে ফারিহার বাবার সেই ঘটনা মনে এসে পড়ল। ফারিহার বাবা একজন রিটায়ার্ড কর্নেল। তাই একটুও বিলম্ব সহ্য করতে পারেন না। ফারিহার জন্য এক সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার প্রস্তাব আসে। ছেলেটা নাকি মেন্স পারলরে রেডি হতে গিয়েছিল, যার কারণ তাদের প্রায় বিশ মিনিটের মতো দেড়ী হয়েছিল। এমন দেড়ী দেখে তার বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হয়ে একটা প্রাক্তন কর্নেলের বাসায় আসতে এমন দেড়ী করেছো, তোমার কি মনে হয়? এটা কিছুই না? Listen to me, son. A soldier's job is to be punctual at any and all times; whether he's defending the country, or protecting his own image. Now, get out." এমনভাবে অপমান করে বিদায় করলো, যে আমিও শুধু শুনেই উনার ভক্ত হয়ে গেলাম। এমন বিচার-আচারের মানুষ আজকাল খুবই সচরচর। আজকাল তো মানুষ ট্রাফিক পুলিশের প্রস্তাবও সহজে ছাড়তে চায় না, উনি তো একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাকেও ছাড় দিলেন না।

অবশেষে বাসায় পৌছে গেলাম। এখন তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে খেয়ে নিই। খাওয়াদাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই অধিকতর মাত্রায় ঘুম পেল। আর স্বজাগ না থেকে ঘুমিয়ে পড়লাম। ফোনটা চার্জ দেয়ার কথা খেয়াল ছিল না। ফোনটা চার্জের অভাবে সারারাত বন্ধই ছিল। রাত তিনটা পর্যন্ত ফারিহা জেগে ছিল আমার জন্য। অপেক্ষায় ছিল আমার অনলাইন হবার। ঘুমোনোর আগে ঠিক তিনটার দিকে আমাকে টেক্সট করলো, "এই শুনো! আমি আজ সারাটা দিন ব্যস্ত থাকবো। ছেলে পক্ষ আমাকে দেখতে আসবে ঠিক তিনটার দিকে। তুমি আমাকে এই সময়ের মধ্যে কোনো টেক্সট দিও না। আমি অবসর পেলে নিজেই তোমাকে টেক্সট দিবনে।"

ফোনে চার্জ না থাকার কারণে সকাল সারে এগারোটায় উঠে ফোন চেক করাতে তার মেসেজ পাইনি। যেই ফোনে চার্জ দিতে গেলাম। এমন সময়েই বিদ্যুৎ চলে গেল। ট্রান্সমিটার পুরে যাওয়ার ফলে বিদ্যুৎ ফিরতে প্রায় দুপুর দুইটা বাজবে। এটা শুনেই আমি ফোনে চার্জ দেয়ার জন্য পাগল হয়ে গেলাম। ফারিহার সঙ্গে পাঁচটা মিনিট কথা না বলে থাকতেই পারি না। মনে হয়, জীবনটা কেমন খালি খালি হয়ে গিয়েছে। এমন অস্থিরতার মাঝে মাথাটাও ঠিকমতো কাজ করে না। আমি সকালের নাস্তা না করেই, আমার বন্ধু সাকিবের বাসার দৌড় দিলাম। চিন্তা করলাম তার বাসায় ফোনটা চার্জ দিয়ে নিব। তাহলে অন্তত পাঁচটা মিনিট তো কথা বলতে পারব। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাকিবের বাসায় পৌঁছানোর পর আন্টির কাছ থেকে জানতে পেলাম, সে বাসায় নেই। আমার আসার কিছুক্ষণ আগেই বের হয়ে গিয়েছিল। তো আমি তার অপেক্ষায়, তার বাসার নিচের চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময়ই আমার বড় চাচা সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাকে চায়ের দোকানে দেখে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, "রাফি! এখানে কি করছো? আজকে না একটার দিকে বের হতে হবে?" আমি উত্তরে বললাম, ",জ্বী চাচ্চু! কিন্তু এলাকায় বিদ্যুৎ না থাকার কারণে বন্ধুর বাসায় চার্জ দিতে এসেছিলাম।" উনি এটা শুনে আমাকে বললেন, "বাবা, একটা দিন মোবাইল না চালালে কি হয়, বলো? একটা দিনই তো। রাতে বাসায় এসে চার্জ দিয়ে দিও।" আমি উনাকে বললাম, "চাচ্চু, কিছু জরুরি কাজের জন্য চার্জ দেয়ার দরকার ছিল।" এটা শুনে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, "কি জরুরি কাজ, বাবা? অন্য কোথাও যাওয়ার প্ল্যান আছে নাকি?" আমি বললাম, "না! না! তেমন কিছু না। একটা ফ্রেন্ডকে এসাইনমেন্টের কথা জিজ্ঞাস করব। আর কিছু না।" এটা শুনে উনি বললেন, "তাহলে, এই নাও আমার ফোন। আমার দিয়ে কল করে জিজ্ঞাস করে নাও।" এটা শুনে আমি বললাম, "কিন্তু চাচ্চু, ওর ফোন নাম্বার তো আমার মুখস্থ নেই। সেটা তো আমার এই ফোনে।" এটা শুনে উনি বললেন, "তাহলে বাবা, আর কিছু করার নেই। এখনের জন্য চলো। রাতে ফোনে চার্জ দিয়ে একবারেই কল দিও। তাড়াতাড়ি চলো, বাবা! সাদমান, অন্তর আর অনন্ত কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে।" আর কোনো ধরনের বাহানা না দিতে পারায়, উনার সঙ্গেই বাসায় চলে গেলাম।

বাসায় এসে, নাস্তা করে, গোসল করে, দুপুর সারে বারোটার মধ্যে ঝটপট রেডি হয়ে গেলাম। বের হওয়ার আগে ভাইয়া আমাকে বললো, "শুনেছিস, নাকি? মেয়েটার নাকি কোনো ছোট বোন নাই! বাবা-মার একমাত্র। সরি ভাই, এইবার তোর জন্যও একটা নিতে পারব না বোধহয়।" আমি একথা শুনে, হেসে জিজ্ঞাস করলাম, "ভাইয়া, তাহলে কি এই মেয়েটাও বাদ?" ভাইয়া উত্তরে বললো, "না! বাদ কিনা, এটা এখন কিভাবে বলবো? ঐ কাপড় ধোয়ার TVC-এর কথা মনে নেই? 'ব্যবহারের পরেই বিশ্বাস' কি? ঠিক বললাম না?" আমি আবার হেসে বললাম, "ঠিক বলছো, ভাইয়া! একদম ঠিক!" আমার অল্প প্রাণ হাসিটা দেখে ভাইয়া বুঝে গেল আমি কিছু নিয়ে চিন্তায় আছি। আমাকে চিন্তার বিষয় জিজ্ঞাস করাতে, আমি সবকিছু খুলে বললাম। আমার সমস্যার কথা শুনে, ভাইয়া বললো, "চিন্তা করিস না। রাতে যখন এতো সময় পরে তোর সঙ্গে কথা হবে, তখন দেখবি মেয়েটাও যে তোর ছাড়া থাকতে পারে। সেখান থেকেই তোর প্রেমের যাত্রা শুরু করে ফেলিস। এখন চল্! দেড়ী হলে আবার ঝামেলা হয়ে যাবে।" কথাগুলো শুনে অনেক উৎসাহের সঙ্গে গিয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম।

আম্মু, বাবা এবং চাচা-চাচিরা অন্য গাড়িতে গেলো। আমি যে গাড়িতে বসেছিলাম, সেই গাড়িতে ছিল; ভাইয়া, ঘটক এবং আমার চাচাতো ভাইরা। প্রত্যেক বারের মতোই এবারও আমি গাড়ির পিছনের সিটে বসলাম আমার তিন চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে। গাড়ি ছেড়ে দেয়ার কিছুক্ষণ পরেই ঘটকটা মেয়ের অসংখ্য গুণ গাওয়া শুরু করে দিল। আমি তা শুনে, মনে মনে বলছিলাম, "আরে ভাই, মেয়েটা দুনিয়ার যতই যা হোক, আমার ফারিহার তুলনায় কি?" এটা ভাবতে ভাবতে চেহারায় এক মুচকি হাসি আপনাআপনি এসে পড়ল। অন্তর আমার কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞাস করলো, "কিরে? তোর নতুনটার খবর কি?" আমি উত্তরে বললাম, "সকাল থেকে কথা হয়নি মোটেও। ফোন তো চার্জের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে, তার উপরে আবার বাসায় বিদ্যুৎও ছিল না সকাল থেকে।" এটা শুনে সাদমান বললো, "ওহ্! তো এই জন্যই তো বলি আজ তোর চেহারার চমক কই গেলো!" আমি বললাম, "হ্যাঁ ভাই, আর বলিস নারে!" আমার অবস্থা দেখে সাদমান নিজের ফোন আমার হাতে দিয়ে বললো, "নে ভাই, লগিন করে, তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে নে।" আমি তার এই অফারটা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলাম। ভাবলাম, আর কতটাই দূর হবে মেয়ে পক্ষের বাসা! এই অল্প কিছু সময় কথা বললে, আর কথা শেষ হবে না। ফারিহার সঙ্গে কথা বলার মাঝেই যদি হঠাৎ কথা থামাতে হয়, তাহলে অস্থিরতা আরো বৃদ্ধি পাবে। অনেকক্ষণ পরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছি, এখন হাল ছেড়ে দিল চলবে না। আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তো পৌঁছেই যাব। একথা চিন্তা করে বললাম, "না ভাই, থাক্! লাগবে না।" এটার পর প্রায় এক ঘটনারও বেশি হয়ে গেলো, কিন্তু আমরা এখনও পৌঁছাইনি। আমি বিরক্ত হয়ে ড্রাভারকে জিজ্ঞাস করলাম, আর কতক্ষণ লাগবে। ড্রাইভার বললো, আরো বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের মতো লাগবে, তার চেয়ে বেশি নয়। তখন মনে আসল, যে মেয়ে পক্ষের বাসায় যেতে তো প্রায় দুই ঘণ্টা লাগার কথা। তখনই আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাস করলাম, "আচ্ছা, আমরা ঠিক কোন এলাকায় যাচ্ছি?" ড্রাইভার বললো যে আমরা উত্তরায় যাচ্ছি। উত্তরার কথা উল্লেখ করাতে, আমার আবার ফারিহার কথা মনে পড়ে গেলো। ফারিহা থাকে উত্তরার ছয় নং ব্লকের ছয় নং বাসায়। তার ব্যাপারে চিন্তা করতে করতে ভাবলাম, আজকে এলাকাটা ভাল করে চিনে যাই। পরে যখন ফারিহার সঙ্গে দেখা করতে আসব, তখন এলাকা চিনতে অতিরিক্ত খাটতে হবে না। আমি আবার এই কথা চিন্তা করতে করতে ভাবলাম, ফারিহাকে বলে দেখি, যে আমি উত্তরাতে এসেছি। তাকে সারপ্রাইজ দিব। একথা ভেবে সাদমানের কাছ থেকে তার ফোনটা চেয়ে আমার একাউনটে লগিন করলাম। নেটওয়ার্কে সমস্যার কারণে লোড হতে অনেক সময় নিচ্ছিল। পুরোপুরি লোড হতে হতে আমরা প্রায় পৌঁছে গেলাম। তখন আমরা ছিলাম পাঁচ নং ব্লকের কাছে। আমি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাস করলাম, আর কতক্ষণ লাগবে। তখন ড্রাইভার বললো, আর দুই মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব। এতক্ষণে পুরোপুরি লোড হয়ে গেলো। আমি আমার ইনবক্সে ঢুকতে ক্লিক করাতে, আবার লোডিং শুরু হলো। আমি বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে আবার জিজ্ঞাস করলাম, এটা কয় নম্বর ব্লক। ড্রাইভার বললো, এটা ছয় নং ব্লক। সেই মুহূর্তে আমার মনে কিছু টান দিল। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে বললো, এসে পড়েছি আমরা। তখন সময় ছিল ঠিক ২:৫৯। তখন সবাই গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে উনাদের বাসায় নক্ করলাম। আমি সবার পিছনে, হাতে সাদমানের মোবাইল নিয়ে, দাঁড়িয়ে ছিলাম। দরজা খুলে আমাদের ভিতরে আমন্ত্রণ করা হলো। মেয়ের বাবা আমাদের জিজ্ঞাস করছিলেন, যে আমাদের পথ চিনতে কোনো কষ্ট হয়েছিল কিনা। তখনই ঘটকটা আগে গিয়ে বললো, "কি বলেন এসব? আমি থাকতে আবার রাস্তা চিনতে কিসের কষ্ট?" এটা বলেই হাসতে শুরু করে দিল। সবাই বসে কথা বলা শুরু করলো, আর পাশ দিয়ে অনন্ত আমার কানে ফিসফিস করে বারবার বলছে, "চল্ ভাই, বাহিরে আয়। সকাল থেকে সিগারেট খাইনি। পাঁচ মিনিটের জন্য আয়।" আমি মানা করাতে, আমাকে তার ফোনে লগিন করতে দিবে বলে লোভ দিয়ে নিয়ে গেলো। ওরা তিনজন টংয়ের একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল, আর আমি তার ফোনে লগিন করে তাড়াতাড়ি ইনবক্সে ঢুকলাম। ইনবক্সে ঢুকার সাথে সাথে দেখি তার টেক্সট। টেক্সটে লেখা ছিল, আজ তিনটার দিকে তার বাসায় ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে। তখন আমার অন্তরের সেই ভয় বাড়তে লাগল। আমি তখন আমার চাচাতো ভাইদের জিজ্ঞাস করলাম, এটা ছয় নং ব্লকের কয় নম্বর বাসা। তাদের কারোও খেয়াল ছিল না, তাই আমি তাড়াতাড়ি তাদেরকে নিয়ে ফেরত গেলাম। বাসায় ঢুকেই দেখি নিল রঙের সেলওয়ার কামিজ পড়া এক রূপসী মেয়ে এসে ভাইয়ার সামনে বসে গেলো। মেয়েটার চেহারা ঢাকা ছিল ওড়না দিয়ে। আমি একটু কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম তার গোলাপি ঠোঁট। তার কমল হাতে লাগানো মেহেদি। মেয়েটা ঠিক তেমনই সেলওয়ার কামিজ পড়া ছিল, যেটা আমি কিছুদিন আগে ফারিহাকে দিয়েছিলাম তার জন্মদিনের উপহার হিসেবে। ছয়টা ঘণ্টা, পাঁচটা মার্কেট খুঁজে, পেয়েছিলাম এমন ড্রেস। বাংলাদেশের টপ ব্র্যান্ডের, লিমিটেড এডিশন ডিজাইনের মধ্যে, এই একটাই পেয়েছিলাম নিল রঙের। ফারিহা ওয়াদা করেছিল, এটা সেদিন পড়বে, যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হবে। যেখান থেকে কিনেছিলাম, সেখান থেকে তো গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিল, এমন ড্রেস এই সমগ্র পৃথিবীতে আরেকটা নেই। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মনের একটাই ইচ্ছা ছিল, আরে সেটা হলো, "এমন ড্রেস যাতে বিশ্বের প্রত্যেক জায়গায় পাওয়া যায়।" কিন্তু আমার শত ইচ্ছার পরও, কখনও বাস্তবতা পাল্টাতে পারবে না। আমি জানতাম ঘটনাটা কিরূপ বিরাট পর্যায়ে ঘটেছে। আমি জানতাম ইহা এড়ানোর কোনো উপায় আমার হাতে নেই। শুধু ভাইয়ার পাশে চুপচাপ বসে সব সহ্য করতে হবে। আমি কখনও তার কাছে ভাইয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলিনি। আজ তার চোখের সামনে বসে আছে ভাইয়া, আর ভাইয়ার সামনে ফারিহা। বাবা বললো, ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই কিছুক্ষণ একা কথা বলার সুযোগ দেয়া হোক্। আমি সবার আগে দাড়িয়ে, দ্রুত গতিতে হাঁটা শুরু করলাম। তখনই ভাইয়ার আমার হাতটা ধরে জিজ্ঞাস করলো, "তুই কোথায় যাচ্ছিস? তুইও আমার সাথে থাকবি এখানে।" আমি বেশি কিছু না বলেই আবার বসে পড়লাম। বাকি সবাই ভিতরের রুমে চলে গেলো। আমার মাথায় তখন অসংখ্য হাবিজাবি ঘুরছিল। ভাইয়া আমার চেহারার মরা মরা ভাব দেখে, আমাকে জিজ্ঞাস করলো, "কিরে? তোর চেহারার বারোটা বেজে আছে কেন? কোনো সমস্যা?" আমি উত্তরে বললাম, "না ভাইয়া, এতো লম্বা যাত্রা করার কারণে একটু মাথা চক্কর দিচ্ছে।" এটা শুনে ভাইয়া বললো, "আচ্ছা দাড়া, উনার কাছে জিজ্ঞাস করে দেখি বাসায় কোনো ওষুধ আছে কিনা।" আমি বললাম, "না ভাইয়া! ওষুধের কোনো দরকার নেই। এক গ্লাস পানি হলেই চলবে।" এটা শুনে ফারিহা বললো, "দাঁড়ান! আমি নিয়ে আসছি।" ফারিহার নিজের হাতে আমাকে পানি দিয়ে গেলো। কিন্তু একবারও আমার চোখের দিকে তাকায়নি। তার এই আচরণ দেখে নিশ্চিত হয়ে গেলাম, সেও আমাকে চিনতে পেরেছে। আজ ভাইয়া নিজের নিল রঙের কনট্যাক্ট লেন্স পড়েছিল। আমি আজ প্রথমবার এমন এক মেয়ে দেখলাম, যে ভাইয়ার দিকে একাধিকবার তাকিয়েও স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে। ফারিহা আজ পর্যন্ত সাতানব্বইটা প্রস্তাব ফেলে দিয়েছে। তার মধ্যে প্রেমের প্রস্তাব প্রায় ষাটটা এবং বাকিগুলো বিয়ের প্রস্তাব। আমি জীবনে প্রথমবার ভাইয়ার পাশে বসেছিলাম, এই আশা নিয়ে যে মেয়েটা, তাকে অপছন্দ করবে। অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে, বাকি সবাই ফিরে আসা শুরু করলো। ছেলে এবং মেয়ে উভয়কে তাদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জিজ্ঞাস করা হলো। ফারিহা বললো, তার কিছুদিন চিন্তা করতে সময় দিতে হবে। ভাইয়া তার কথায় সম্মতি জানানোতে সবাই বাসার ফেরত যাওয়ার জন্য বের হলাম।

সারাটা পথ নীরবতায় কাঁটালাম। কি আর করবো? আর কিছু বলার ছিলই না। বাসায় গিয়ে ফোনটা একঘন্টা চার্জ দেয়ার পরে অন করলাম। অন করেই ইনবক্সে ঢুকলাম।
তার টেক্সট দেয়া। তার টেক্সট দেখেই আমাদের কথা শুরু হলো;

- অবশেষে অবসর পেলাম! কি খবর তোমার?
- আলহামদুলিল্লাহ্! তুমি কেমন আছো?
- আলহামদুলিল্লাহ্! অনেক ভাল।
- বাহ্! এতো আনন্দ কীসের? ছেলে পছন্দ হলো নাকি?
- Not exactly! কিন্তু ছেলের ছোট ভাইটা মারাত্মক ছিল।
- ওহ্! তাই নাকি?
- হ্যাঁ!
- তাহলে তোমার বাবাকে বলো, ছোট টার সঙ্গেই তোমার বিয়ে দিয়ে দিতে।
- এতো সহজ না গো! বাবা তো চায় প্রতিষ্ঠিত ছেলে। ওর ছোট ভাইটা তো মনে হয় এখনও গ্র্যাজুয়েশনই শেষ করেনি।
- তাহলে, এমন ছেলেই পছন্দ করলা কেন?
- মন কি এত কিছু বুঝে, বলো? যার সঙ্গে হারিয়ে যাওয়ার বায়না ধরে বসে, তাকেই তো চিরকাল খুঁজে বেড়িয়ে যায়। অন্য কারো অনুসন্ধানে তার কোনো কিছু, না আসে, না যায়।
- তুমি কবে থেকে থেকে সাহিত্যিক হয়ে গেলা?
- আজ বিকাল থেকেই! দেবদাসের মতো মনে হচ্ছে নিজেকে।
- কেন? মদ সেবন করেছো?
- না গো! জীবনের নেশার তুলনায় এই মদ কি জিনিস? মদ তো তারা পান করে, যারা জীবনের নেশা সহ্য করতে পারে না। আমি তো ইহা নিয়েই অনেক সন্তুষ্ট আছি।
- যা ই হোক! আমাকে পানি দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। তখন মাথা চক্কর দেয়ার কারণে ঠিকমতো ধন্যবাদ জানাতে পারিনি।
- ধন্যবাদের কিছু নেই। এক গ্লাস পানিই তো!
- তুমি আমাকে ওয়াদা করেছিলা, আমার দেয়া ড্রেসটা সেদিন পড়বে, যেদিন আমাদের প্রথম দেখা হবে। সেটা আজ পড়ে, এভাবে ছেলে পক্ষের সামনে আসাটা কি ঠিক হয়েছিল? তোমার ওয়াদাটা তো রক্ষা করতে পারলা না।
- কীভাবে পারলাম না? আজ তো আমাদের প্রথম দেখা ছিল, আর আজকের দিনই আমি ড্রেসটা পড়লাম। তাহলে তুমিই বলো, কীভাবে ওয়াদা রক্ষা করতে পারলাম না?
- ড্রেসটা যে উদ্দেশ্যে পড়েছিলা, আর যে উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে, দুটো ভিন্ন বিষয়। তুমি ড্রেসটা পড়েছিলা ছেলে পক্ষের সামনে উপস্থাপনের জন্য, আমার সামনে নয়।
- তোমার মতো মেধাবী পুরুষের মুখ থেকে যখন এমন মূর্খতা সম্পন্ন কথা শুনতে পাই, তখন খুবই অবাক লাগে। মনে হয় জেন, রাফি শুধু একটা নয়, তার আরেকটা মূর্খ রূপও রয়েছে।
- What does that supposed to mean?
- It means, I knew that you were coming from the get go.
- কীভাবে? আমার আগমনের সংবাদ কোথায় পেলা?
- গতকাল ঘটকটা বিকেল বেলায় আমাদের বাসায় এসেছিল। সে ছেলের যে কয়টা ছবি দেখল, তার মধ্যে অধিকাংশ ছবিতে তুমি ছিলে। আমি জিজ্ঞাস করাতে আমাকে বললো যে তুমি ছেলের আপন ছোট ভাই। তাই তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা উপলক্ষে ড্রেসটা পড়ে ছিলাম।
- Damn! আমার জন্য এতো ঝামেলা! I'm pleasantly surprised! Thank you.
- নিজের দেয়া ড্রেস পড়ার জন্য তো “Thank you" বললা ঠিকই, কিন্তু এতো কষ্ট করে যে তোমার জন্য তোমার পছন্দের কাচ্চি রান্না করলাম, সেটার ব্যাপারে তো কিছুই বললা না!
- Wait! কাচ্চি তুমি রান্না করেছিলা?
- জ্বী হ্যাঁ! এজন্যই তো টেক্সটে বলেছিলাম যে সারাদিন ব্যস্ত থাকবো।
- বুঝতে পেরেছি! একা একা রান্না করতে পারলা?
- একা একা না! আম্মু তো ছিলই সাহায্য করতে।
- তাহলে, আন্টিকে আমার দিক থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিও!
- তুমি অনেক পচা!
- আজকে জানলা?
- জ্বী!
- আচ্ছা, শুনো!
- না! শুনবো না।
- অনেক জরুরি তো।
- হোক্ জরুরি! জরুরি হলেও তোমার জন্যই হবে, আমার জন্য না।
- যদি আমি বলি, আমাদের উভয়ের জন্যই জরুরি?
- যদি এমন কিছুই হয়ে থাকে, তাহলে বলো।
- এখন সময় রাত ১১:৩৬! ঠিক একটা বছর আগে এই মুহূর্ত থেকে আমাদের কথা শুরু হয়েছিল।
- বাহ্! তুমিও সময়টা মনে রাখলা?
- না! খুঁজে বের করলাম। কয়েকমাস আগে আমাদের চ্যাট হিস্টরি ঘাটতে ঘাটতে পেয়েছিলাম।
- ওহ্ আচ্ছা! এতটাই বলার ছিল?
- না! আরো কিছু কথা আছে।
- আচ্ছা, শুনো! আমারও কিছু বলার ছিল।
- আচ্ছা, বলো।
- না থাক্! তুমি বলো।
- Ladies first.
- আচ্ছা! I love you. I want to be yours till the end of time. তোমার দেয়া এই ড্রেস যেভাবে আমার শরীর সঙ্গে মিশে যায়, সেভাবেই আমার আত্মাকে তোমার আত্মার সঙ্গে মেশাতে চাই।
- কি বলছ এসব? পাগল হয়ে গিয়েছ তুমি? আমার ভাইয়া আজ বিকালেই তোমায় দেখে এলো, আর এখন তারই ছোট ভাইকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছ? Are you out of your mind?
- তোমার মনে আমার জন্য কোন ধরনের অনুভূতি নেই?
- থাকলে তো আমি নিজেই বলতাম।
- না! বলতা না। আমি তোমাকে ভাল করেই জানি।
- যদি এত কিছুই জানো, তাহলে ভাইয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দাওনি কেন?
- আমি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম।
- কিসের ব্যাপারে?
- তোমার মনে কি আছে, সেটার ব্যাপারে।
- এসব করে কি নিশ্চয়তাটা পেয়েছ তুমি?
- যখন তোমাকে পানি দেয়ার জন্য তোমার কাছে এসেছিলাম, তখন তোমার চোখে দেখতে পেলাম তোমার প্রকৃত অনুভূতি। আমি ভাল করেই জানি তোমার উপর আজ মারাত্মক পরিমাণের অত্যাচার গিয়েছে। এই অত্যাচারের বাকি অংশটুকুর কারণেই তুমি এই মুহূর্তে কান্না করছ।
- তুমি কিভাবে জানো আমি কান্না করছি কিনা?
- কারণ আমিও তোমার যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কান্না করেই যাচ্ছি।
- কিন্তু কেন? কেন করছো এমন? তুমি জানো না, আমাদের ভবিষ্যতের সকল সম্ভাবনা শেষ হয়ে গিয়েছে?
- আমি এসব জানি বলে কাঁদছি। আমি এই কঠিন সত্য নিতে পারছি না।
- সব ভুলে যাও! মনে করে নাও রাফি নামক কোনো ব্যক্তিকে তুমি কখনও চিনতে না।
- ঠিক আছে। ধরে নাও, আমি কোনোভাবে তোমাকে ভুলে গেলাম। কিন্তু তুমি কি আমাকে ভুলতে পারবে?
- তোমার জীবনে আমার ভুমিকা থাকাটা পুরোপুরি বৃথা।
- আমার অনুভূতিগুলোকে এভাবে মাটি করে ফেলবা?
- হ্যাঁ! এটাই করতে হবে। তোমার অনুভূতিগুলোকে মাটি করে, নিজের অনুভূতিগুলোকে সেটার মধ্যে দাফন করে দিব।
- তুমি চাইলেই কিছু করতে পারো।
- কিছু করার দায়িত্ব কি শুধু একান্ত আমার?
- আমার পরিবারের সামনে তোমাকে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্যেই আজ তোমার কাছে আমার মনের কথা প্রকাশ করলাম। নাহলে আরো আগেও কখনও বলতে পারতাম।
- শুধু আমাকে উপস্থাপন করাতেই যদি হয়ে যেত, তাহলে আমি এতদিন এভাবে অপেক্ষায় থাকতাম না, অনেক আগেই তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসে পড়তাম।
- তুমি তোমার ভাইয়াকে বলে দেখো। সে তোমার সব কথা শুনে।
- আমার ভাইয়া আমার প্রত্যেকটি চাহিদা, আমার বলার আগেই পূরণ করেছে। জীবনে প্রথমবার ভাইয়া কিছু চাচ্ছে, সেটা আমি কি করে কেড়ে নেই, বলো?
- তুমি না বললে, আমি নিজেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিব।
- হ্যাঁ। সেটাই করো। প্রস্তাব ফিরিয়ে দাও। আমি তোমাকে নিজের করতে না পারলে, নিজের ভাবি হিসেবেও দেখতে চাই না। আর অবশ্যই ভাল একটা কারণ দিও, যাতে গতবারের মতো তোমার ফুপ্পি তোমাকে থাপ্পড় না মারতে পারে। ভাইয়া তোমাকে বিয়ে করতে আগ্রহী, তাই আমি ভাইয়াকে মানা করতে পারব না। আজ বাসায় ফেরার পর ভাইয়া আমাকে জিজ্ঞাস করলো, "তোর কাছে মেয়েটা কেমন লেগেছে?" আমি বললাম, "ভাইয়া, বিয়ে তুমিই করবা। আমার পছন্দ-অপছন্দ দিয়ে কি যায় আসে?" ভাইয়া বললো, "এতদিনের মধ্যে মনে হচ্ছে, ভাল একটা মেয়ে দেখতে পেলাম। তার তরফ থেকে হ্যাঁ থাকলে, আমার দিক থেকেও হ্যাঁ।" এটা শুনার পর থেকে আমি চরম পরিমাণের দুশ্চিন্তায় পড়ে গলাম। তাই তোমার কাছে বিনতী করছি, ভাইয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দাও আর আমাদের জীবন থেকেও সরে যাও।

এসব বলার পরে, তার রিপ্লাইয়ের জন্য সারাটা রাত অপেক্ষায় স্বজাগ ছিলাম। কিন্তু তার তরফ থেকে কোনো রিপ্লাই পাওয়া যায়নি। পরের সকালে তার বাবা ফোন করে জানিয়ে দিল, তার মেয়ের তরফ থেকে না আছে। এই সংবাদ শুনে আনন্দ না পেয়ে থাকলেও, মনের শান্তি পেয়েছিলাম প্রচুর পরিমাণে। শান্তি ছিল মূলত দুই কারণে। প্রথম কারণ; এখন আর ফারিহাকে আমার ভাবি হিসেবে দেখতে হবে না। আর দ্বিতীয় কারণ; অবশেষে আমার প্রেমে এমন এক মেয়ে পড়ল, যে ভাইয়ার দিকেও আকর্ষিত হয়নি। আসলে, আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, তার প্রতি আমার যে অনুভূতি ছিল, সেটা ভালবাসা ছিলই না। সেটা ছিল এক ধরনের জিদ। যৌবনকালে এমন প্রায়ই হয়। কোনো মেয়ের চোখে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে দেখার সন্তুষ্টি অতুলনীয়। মাঝেমধ্যে আমারও মন চায়, তার দেহের সুবাসে নিজেকে আবৃত করে নিতে। মাঝেমধ্যে আমারও মন চায়, তার কেশের তলে বসে দিন কাটিয়ে ফেলি। মাঝেমধ্যে আমারও মন চায়, তার গলার মিষ্টি স্বরে, তার কোলে শুয়ে বিশ্রাম করি। মাঝেমধ্যে আমারও মন চায়, তার সেই দুটো গাঢ় বাদামি চোখের দিকে তাকিয়ে সারাদিন-সারারাত কাটিয়ে ফেলি। তার সেই কোমল হাতের আঙ্গুলগুলোর মাঝে আমার হাতের আঙ্গুলগুলো রেখে, তার কপালের উপর আমার ঠোঁট রেখে প্রতিটা বেলা পার করতে চাই।

জানি না, সে এখন কেমন আছে, কোন অবস্থায় আছে। কিন্তু আশা করি সর্বদা ভালই থাকবে। হতে পারে কিছু সময় পর ফারিহার জায়গায় অন্য কোনো 'সে' আসবে আমার জীবনে। কিন্তু তাহারই অপেক্ষায় এখন বেঁচে থাকতে হবে।